ঢাকা মঙ্গলবার, ৬ই মে ২০২৫, ২৩শে বৈশাখ ১৪৩২


‘পুলিশ কি তোর বাপ-দাদার কেনা গোলাম!


৪ এপ্রিল ২০১৯ ০৮:২৬

আপডেট:
৬ মে ২০২৫ ০৫:০৬

রাত সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎ বাড়ির দেয়াল ভাঙার শব্দ। এতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন ফজলুল করিম রানা ও তার পরিবার। ডাকাত ভেবে চিৎকার করলেও কেউ এগিয়ে আসছিল না। এরপর তিনি সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানার ওসির কাছে সাহায্য চান। কিন্তু, তিনি ব্যস্ত আছেন বলে জানান। পরে আবারো ওসির কাছে সাহায্য চাইলে তিনি বলেন ‘পুলিশ কি তোর বাপ-দাদার কেনা গোলাম, ডাকামাত্র তোর বাড়ি হাজির হবে?’

বাড়িতে হামলার ঘটনায় নিরাপত্তা চেয়ে পুলিশকে ফোন করে নিজের অভিজ্ঞতার বিবরণ এভাবে জানাচ্ছিলেন সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ফজলুল করিম রানা।

পরে পুলিশ না আসায় সার্কেল এএসপিকে আবারো জানান তিনি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানানোর মাশুল হিসেবে ফজলুল করিমের মামলা নিতে অস্বীকার করেন শ্যামনগর থানার ওসি হাবিল হোসেন।

ফজলুল করিম এ ব্যাপারে রিট আবেদন করলে হাইকোর্ট ওই ওসির বিরুদ্ধে রুল জারি করেন।

ফজলুল করিম সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজান নগর ইউনিয়নের সোরা গ্রামের আবুল কাশেম সরদারের ছেলে। তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ফজলুল করিম বলেন, ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার রমজান নগর ইউনিয়নের সোরা গ্রামে আমার বাড়িতে আসি। ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে আমার বাড়ি ভাঙা হতে থাকে। পুলিশকে বারবার অনুরোধ করার একপর্যায়ে ওসি বলেন, আগামীকাল সকালে দেখা না করলে আদালতে চালান করে দেব।

ফজলুল করিম রানা বলেন, ‘এরপর আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লিখে প্রশাসনের সাহায্য প্রার্থনা করি।

রানা আরও বলেন, ‘এরপর কালীগঞ্জ সার্কেলের এএসপিকে ফোনে বিষয়টি জানানোর পাশাপাশি ৯৯৯-এ ফোন করে সাহায্য চাইলে শ্যামনগর থানার একজন এএসআই ঘটনাস্থলে আসেন। কিন্তু ততক্ষণে হামলাকারীরা নগদ দুই লাখ টাকা, ৮০ হাজার টাকা মূল্যের দুটি স্বর্ণের চেন ও ৫০ হাজার টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় তারা বাড়ির সীমানা প্রাচীরও ভেঙে ফেলে। হামলাকারীরা আমাকে এবং আমার বাবা-মাকে মারধর করে পালিয়ে যায়’।

ফজলুল করিম বলেন, ঘটনাস্থল থেকে ওসিকে ফোন করে আমার সঙ্গে কথা বলতে বলেন এএসআই। ওসি তখন ফোনে আমাকে বলেন ‘ওপর মহলে নালিশ করিস? তোর মামলা হবে না। কোর্টে মামলা কর’। পরদিন এসআই মনিরুজ্জামান ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করে বলেন, মামলা হবে না। পারলে চেয়ারম্যানের সঙ্গে বসে মীমাংসা করে নিতে হবে। কিন্তু আমি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সাতক্ষীরার পুলিশ সুপারের কাছে সব ঘটনা জানিয়ে লিখিত অভিযোগ করি।’

২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ সুপার শ্যামনগর থানার ওসিকে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নিতে লিখিত নির্দেশ দেন। কিন্তু, এরপরও ওসি কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় ৩ মার্চ হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ফজলুল করিম। এরপর ১০ মার্চ প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিষয়টি খোঁজ নিতে মৌখিক নির্দেশ দেন আদালত। পরবর্তীতে মঙ্গলবার আবার রিটের শুনানি করতে গিয়ে ঘটনার আংশিক সত্যতা পাওয়ার তথ্য আদালতকে অবহিত করেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুল আলম।

রিট আবেদনে শুনানির পর মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ পুলিশকে মামলা নেওয়ার আদেশ দেন।

এদিকে সাতক্ষীরা শ্যামনগরের ওসি হাবিল হোসেন বলেন, ‘ফজলুল করিমের বাবা আবুল কাশেম সরদারের অভিযোগে ২ এপ্রিল সকাল ১০টায় এজাহার নামীয় ১০ জনসহ মোট ১৫ জনকে আসামি করে ডাকাতির মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। মামলা নং-৩ (তারিখ: ২.৪.১৯)। মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন ইউসুফ, আয়ুব হোসেন, শমসের, রেজাউল, নাদির সরদার, রফিসহ ১৫ জন। এই আসামির মধ্যে আবুল কাশেম সরদারের একজন আপন ভাই এবং একজন সৎ ভাই রয়েছে।’

এর আগে মামলা না নেওয়ার ব্যাপারে ওসি আরও বলেন, ‘ফজলুল করিমের বাবা আবুল কাশেম সরদারের আপন ভাই ও সৎ ভাইদের সঙ্গে জমি-জমা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে জমি-জমা নিয়ে মারামারি এবং ভাঙচুরের ঘটনায় তিনি শ্যামনগর থানায় অভিযোগ দেন। বলেন, তাদের বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। আমরা তদন্ত সাপেক্ষে মামলা নিতে চেয়েছিলাম। জমিজমা নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকে তারা মিথ্যা ডাকাতির মামলা করতে চেয়েছিলেন। সেজন্য তাদের প্রাথমিকভাবে মামলা না নিয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে বসে মীমাংসা করে নিতে বলা হয়েছিল।

তিনি আরও বলেন, ‘ওই রাতে ফজলুল করিমের সাহেব আমাকে ফোন করা মাত্র আমি এসআই মনিরুজ্জামানকে ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছিলাম। পরের দিনও পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করে। কিন্তু বাদীদের যে অভিযোগ ছিল সেটা সত্য ছিল না। সে কারণে মামলা নেওয়া হয়নি। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হচ্ছে সেটা সঠিক নয়।’

সর্বশেষ আদালতের নির্দেশে কেন ডাকাতির মামলা রেকর্ড করা হলো সে বিষয়ে ওসি বলেন, ‘ডাকাতির মামলা নেওয়া হয়েছে। তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ এর বেশি তিনি কিছু বলতে চাননি।

উল্লেখ্য, সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানায় মামলা না নেওয়ায় অভিযোগে দায়ের করা রিটের শুনানিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘ওসি সাহেবরা সব জায়গায় কোর্ট বসিয়ে দেন। ওসি কী সালিশ করতে বসেছেন? তারা সুবিধামতো হলে মামলা নেবেন, অথচ টাকা ছাড়া থানায় একটা জিডিও হয় না।’

মঙ্গলবার রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানিতে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই মন্তব্য করেন। শ্যামনগর থানায় মামলা না নেওয়ার প্রসঙ্গে আদালত বলেন,‘ওসি মামলা নিলেন না কেন? আমরা রুল দিয়ে দেখি কেন তিনি মামলা নিলেন না।’ এরপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ওসিরা যেখানে সেখানে কোর্ট বসায়, রাতে কোর্ট বসায়। এতো সাহস তারা কোথায় পায়? তারা নিজেরা বিচার বসায় কীভাবে?’

সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. সাজ্জাদুর রহমান জানিয়েছেন, পুলিশ একটি সুশৃংখল বাহিনী। কেউ ভুল করলে ভুলের খেসারত দিতে হয়। ওসি হাবিল হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে যেহেতু বিষয়টি এখন উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে, তাই আদালতের বিষয়টি শেষ হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এসপি সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘আমি মামলা নেয়ার জন্য ওসিকে লিখিতভাবেই নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি মামলা নেননি। এরপর ভুক্তোভোগী আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন। আদালতের মাধ্যমেই ভুক্তভোগী প্রতিকার পেয়েছেন। এখন আদালতের নির্দেশেই সব হবে।’

তিনি বলেন, ‘উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী এখন সব হচ্ছে। আদালতের প্রক্রিয়াটি শেষ হলেই ওসির বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’