ঢাকা মঙ্গলবার, ২১শে মে ২০২৪, ৮ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


আইএসের ‘বায়াত’ নিয়ে সক্রিয় অর্ধশত জঙ্গি


৩ ডিসেম্বর ২০১৯ ২২:৩৮

আপডেট:
২১ মে ২০২৪ ১১:৩৩

দেশে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএসের ভাবাদর্শী জঙ্গিদের সংখ্যা বাড়ছে। রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে আইএস ভাবাদর্শী হিসেবে যেসব জঙ্গি শনাক্ত হয়েছিল তাদের অধিকাংশই ধরা পড়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে।

অনেকে নিহতও হয়েছে। সম্প্রতি গুলশান হামলা মামলার রায়ে গ্রেপ্তার আটজনের মধ্যে সাতজনকে ফাঁসির দণ্ড দিয়েছে আদালত। একজন খালাস পেয়েছে। তারপরও থেমে নেই আইএসপন্থি নব্য জেএমবির কর্মকাণ্ড। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের একাধিক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে এসব তথ্য জানিয়েছেন।

তারা জানান, অনলাইনে আইএসের শীর্ষ নেতার বয়ান শুনে দেশের অভ্যন্তরে ঘরে বসেই ‘বায়াত’ (বিশ্বস্ততা) গ্রহণ করেছে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া অনেক তরুণ। যারা বিভিন্ন ‘মডিউল’ বা ‘সেলে’ বিভক্ত হয়ে আইএসের বায়াত গ্রহণ করে ভিডিও বা অডিও ধারণ করে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠনের চ্যানেলে প্রেরণ করেছে।

গুলশান হামলা মামলার রায় পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় সিটিটিসিপ্রধান মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, দেশে ব্যাপকহারে রেডিক্যালাইজড (জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ) যুবকের সংখ্যা বেড়েছে। তবে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ ব্যক্তিদের টেররিস্ট বা সন্ত্রাসী হয়ে ওঠার জন্য যে ধরনের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের দরকার তেমন কোনো নেতা নেই। তাই তারা হামলার ঘটনা ঘটাতে পারছে না।

সিটিটিসির অন্য এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘সম্প্রতি তিন জঙ্গি নেতা গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদ ও অন্যান্য মাধ্যমে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পেরেছি, দেশের অভ্যন্তরে প্রায় অর্ধশত আইএসপন্থি জঙ্গি রয়েছে, যারা অনলাইনে আইএস শীর্ষ নেতার বয়ান শুনে ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শামিল ও সংগঠনের বিশ্বস্ততা ঘোষণা করে।

চার-পাঁচজনের সমন্বয়ে গঠিত ভিন্ন ভিন্ন সেল তাদের নিজস্ব আস্তানায় অবস্থান করে একে অন্যের হাতের ওপর হাত রেখে শপথবাক্য পাঠ করে। সেই শপথের অডিও ও ভিডিও ধারণ করে আইএসের নিজস্ব চ্যানেলে পাঠিয়ে দিয়েছে।’

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, তাদের পাওয়া তথ্যমতে জঙ্গিদের ‘মডিউল’ বা ‘সেল’ রয়েছে ৮-১০টি। এসব সেলকে কেউ কেউ ‘প্যাক উলফ’ নামেও অভিহিত করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা হলেও এসব সেল বা মডিউলের কর্মকাণ্ডের ভিন্ন ভিন্ন কৌশল রয়েছে। একটি সেলের সঙ্গে আরেকটির যোগাযোগ নেই।

কোনো কোনো সেল ধারালো অস্ত্র বা ‘কমান্ডো নাইফ’ দিয়ে আঘাত করার প্রশিক্ষণ নিয়েছে, আবার কোনো কোনো সেল বিস্ফোরক ব্যবহারের মাধ্যমে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটিটিসির বোম্ব ডিজপোজাল টিমের অতিরিক্ত উপকমিশনার রহমতুল্লাহ চৌধুরী  বলেন, জঙ্গিদের ভিন্ন ভিন্ন মডিউল বা সেলের অস্তিত্ব সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেলেও তাদের হামলার সক্ষমতা নেই। কারণ তাদের হামলা চালানোর সব ধরনের বিস্ফোরক সংগ্রহের উৎসস্থল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

সিটিটিসির অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, এসব জঙ্গির হামলার প্রধান লক্ষ্য পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও সদস্য। বিশিষ্ট নাগরিকরাও তাদের টার্গেটে থাকে। কারণ এসব ব্যক্তির ওপর হামলা চালালে সহজেই আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রচার পাওয়া যায়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ বা জেএমবির পুরাতন ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী নেতাকর্মীদের মধ্য থেকে যারা আইএস ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়, তাদের নব্য জেএমবি হিসেবে গণ্য করে সিটিটিসি। নব্য জেএমবির প্রধান পৃষ্ঠপোষক তামিম আহমেদ চৌধুরী ২০১৩ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আবদুস সামাদ ওরফে মামু ওরফে আরিফকে সঙ্গে নিয়ে জুন্দ আততাওহীদ আল খলিফা গঠন করেন। এরপর আবদুস সামাদ ওরফে মামু ওরফে আরিফের মাধ্যমে জেএমবিতে যুক্ত হন তামিম চৌধুরী। ২০১৪ সালের ১ রমজানে ইরাকের মুসুলে আবু বক্কর আল বাগদাদি ওরফে ইব্রাহিম ওয়া ইব্রাহিম আইএসের খেলাফত ঘোষণা করার পর তামিম চৌধুরীর মাধ্যমে জেএমবির সব শূরা সদস্য তাকে খলিফা হিসেবে মেনে নিয়ে তার কাছ থেকে বায়াত গ্রহণ করে। এখান থেকেই নব্য জেএমবির শুরুর কাল ধরা হয়।

সিটিটিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, আইএসপন্থি নব্য জেএমবির শুরু থেকে যারা জড়িত তাদের মধ্যে প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তামিম। পরবর্তী বিভিন্ন সময় নেতৃত্বে ছিলেন মুফতি মাওলানা আবুল কাশেম, আবদুস সামাদ ওরফে মামু ওরফে আরিফ, মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন ও সারোয়ার জাহান ওরফে মানিক। এদের মধ্যে আবুল কাশেম ও আবদুস সামাদ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। রিপন গুলশান হামলা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি। তামিম ও সারোয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হয়েছেন। নব্য জেএমবির অনেকেই এ সংগঠনের হাল ধরার চেষ্টা করেছেন। তবে তাদের বেশিরভাগ বিদেশে পালিয়ে থাকায় এ সংগঠন সাংগঠনিকভাবে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে।