ঢাকা শনিবার, ১৮ই মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


ম্যাক্সিম ফাইন্যান্সের অর্থ পাচার মামলা

৬০৩ কোটি টাকার ‘রেকর্ড’ জরিমানা


৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ২১:৪৩

আপডেট:
১৮ মে ২০২৪ ০০:৩৮

এই অর্থ সংগ্রহ করে তারা নানা কৌশলে আত্মসাৎ করেন।’ নথি থেকে আরও জানা গেছে, তারা ম্যাক্সিম মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড নামে একটি সমবায় সমিতি খুলে ঢাকা বিভাগে ১১৩টি শাখা খোলেন।

সমিতির কর্মকর্তারা বিভিন্ন ধরনের আমানত গ্রহণ, শেয়ার বিক্রি, সঞ্চয় গ্রহণসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বিশাল অঙ্কের অর্থ সংগ্রহ করেন। সমিতিটি সমবায় অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়াই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। জনসাধারণের কাছ থেকে জমা নেওয়া অর্থে বিভিন্ন কোম্পানি ও গ্রুপ অব কোম্পানি খোলা হয়।

২০১১ সালের শেষ দিকে আইসিএল, ডেসটিনি, শাহজালাল, আল-আকসাসহ একই ধরনের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে ম্যাক্সিম মাল্টিপারপাস সম্পর্কেও আমানতকারীদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। গ্রাহকরা তাদের অর্থ ফেরতের জন্য চাপ দিতে থাকেন। একপর্যায়ে সমিতির পরিচালক ও স্টাফরা আত্মগোপনে চলে যান।

দুদকের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেনের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সমিতি ও অর্থ আত্মসাতের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন হাবীবুর রহমান; যিনি ম্যাক্সিম ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন।

২০০৫ সালে তিনি এনজিওর চাকরি ছেড়ে ম্যাক্সিম ফাইন্যান্স কো-অপারেটিভ সোসাইটি গঠন করেন। সমিতি গঠনের উদ্দেশ্য হিসেবে লেখা হয় ‘মানুষকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করা ও বেকারত্ব দূর করা’।

সেই লক্ষ্যে সমিতির মূলধন ১ কোটি টাকা ধরে আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। প্রাথমিকভাবে ভর্তি ফি ধরা হয় ১০০ টাকা। এরপর তারা সমিতির শেয়ার বিক্রি করে ও আমানত গ্রহণের মাধ্যমে বড় অঙ্কের পুঁজি সংগ্রহ করে। তারা বৈধ-অবৈধ বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে জনসাধারণকে অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে ৩০৪ কোটি ১০ লাখ ৫৩ হাজার ৬০৪ টাকা আমানত সংগ্রহ করে।

এর মধ্যে ১ কোটি টাকা দিয়ে মৌচাকে ১২ বছরের জন্য একটি জমি লিজ নেয় এবং সমিতির মালিক সেজে নিজেদের নাম্য ব্যবহার করে ঢাকা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনাসহ ১২ জেলায় কিছু জমি ক্রয় করে। অথচ তারা সমবায় সমিতির বিধিমালা অনুসারে এসব জমি ক্রয়ের অনুমতি নেয়নি।’

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘তারা আমানতকারীদের কাছ থেকে ৩০০ কোটি টাকার বেশি আদায় করলেও ১৩ জেলায় ৮ হাজার ৮৮৮ শতাংশ জমি ক্রয় করে প্রায় সাড়ে ৩২ কোটি টাকায়। পুরানা পল্টনে একটি ভবনের ক্রয়মূল্য দেখায় ৪৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।

অথচ এর দালিলিক ক্রয়মূল্য পাওয়া যায় ১২ কোটি টাকা। সর্বশেষ তদন্তে সমিতির ১২৬ কোটি টাকার সম্পদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। অবশিষ্ট ১৪৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকার কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি; যা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।

তা ছাড়া সমিতির টাকায় যেসব সম্পদ ক্রয় করা হয়েছে তার সবই তাদের নিজস্ব কয়েকজন পরিচালকের নামে। সব কোম্পানিতেই ঘুরেফিরে একই সিন্ডিকেটের লোকজনের নাম ব্যবহার করে এসব সম্পদ ক্রয় করায় পুরো ৩০০ কোটি ৯৩ লাখ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ মেলে। ফলে দুদক মোট ২১ আসামির বিরুদ্ধে অর্থ পাচার (মানি লন্ডারিং) প্রতিরোধ আইন-২০১২-এর ৪(২)(৩) ধারায় অভিযোগপত্র দাখিল করে।

১৫ নম্বর আসামি আব্দুল মালেক মারা যাওয়ায় তাকে অভিযোগপত্রে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়।

আদালত যুক্তিতর্ক ও শুনানি শেষে ২১ আসামির সবাইকে সমানভাবে দায়ী করে সমান সাজা দেয়। সাজাপ্রাপ্তরা হলেন ম্যাক্সিম ফাইন্যান্সের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ মফিজুল হক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, খায়রুল বাশার, আবদুল হান্নান সরকার, সৈয়দ শরিফুল ইসলাম, ওলিয়ার রহমান, ফজলুর রহমান, আসাদুজ্জামান, সোলাইমান সরোয়ার, হারুন অর রশীদ, শেখ আবদুল্লাহ আল মেহেদী, সৈয়দ জাহিদুল ইসলাম, মনোয়ার হোসেন, এম এ সাদী, আসলাম হোসাইন, মেহেদী হাসান মোজাফফার, ইমতিয়াজ হোসেন, মিজানুর রহমান, মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান এবং এইচ এম আমিরুল ইসলাম।

রায়ের সময় এমডি হাবিবুর রহমান ও পরিচালক মেহেদী হাসান মোজাফফার, ইমতিয়াজ হোসেন ও আমিরুল ইসলাম আদালতে ছিলেন। পরে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। অপর ১৭ পরিচালক পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত।

আদালত আদেশে বলে, ‘অভিযোগে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আসামিদের প্রত্যেককে দোষী সাব্যস্ত করে বর্ণিত আইনের ৪(২) ধারায় ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো। একইভাবে প্রত্যেক আসামিকে মানি লন্ডারিংয়ে সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগে ৩০০ কোটি ৯৩ লাখ ১২ হাজার ৭৩৯ টাকার দিগুণ পরিমাণ টাকা অর্থাৎ ৬০৩ কোটি ৮৬ লাখ ২৫ হাজার ৪৭৮ টাকার ২১ ভাগের এক ভাগ হিসেবে ২৮ কোটি ৬৬ লাখ ১ হাজার ২১৩ টাকা করে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো।

এই দণ্ডের সমুদয় অর্থ রাষ্ট্র প্রাপ্ত হবে। আসামিদের সব ধরনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হলো। দণ্ডিত আসামিদের রায় ঘোষণার ৬০ দিনের মধ্যে দণ্ডের অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো। ব্যর্থতায় দণ্ডিত অর্থ ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৮৬(১) (বি) ধারার বিধান মতে আদায় করা হবে।’ আদালত আরও বলে, ‘দণ্ডিত আসামিরা ইতিপূর্বে হাজতবাস করে থাকলে হাজতবাসকালীন ফৌজদারি কার্যবিধির বিধান মতে প্রদত্ত সাজা থেকে বাদ যাবে।’