লাশের স্তূপেও বেঁচে আছে মানবতা

ইসরাইলের নৃশংস তাণ্ডবে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ উপত্যকা গাজা এখন মৃত্যুপুরী। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। মসজিদ, গির্জা, হাসপাতাল, বাজার, ঘরবাড়ি, রাস্তা, ধ্বংসস্তূপ— সবখানেই লাশ। সকালের নতুন সূর্যের মতোই প্রতিদিনই নতুন নতুন লাশ জমা হয় গাজার জনপদে। প্রাণভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত মানুষগুলোর মাঝে সারাক্ষণই মৃত্যু আতঙ্ক— কখন ইসরাইল সেনাদের বর্বর তাণ্ডবে নিভে যায় জীবন প্রদীপ! কিন্তু এর মাঝেও যমদূতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জেগে উঠছে তাদের মনুষত্ব, মানবতা! মা হারা ছোট্ট শিশু মোহাম্মদ তার জলজ্যান্ত উদাহরণ!
এক বছরেরও বেশি সময় পর বাবার কোলে ফিরেছে ছোট্ট মোহাম্মদ। হাসিমাখা মুখের অবুঝ শিশুটি হয়তো জানেও না কি হয়েছে তার সঙ্গে। গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে প্রাণ হারিয়েছে তার মা। সেই মায়ের মরদেহের পাশেই কাঁদছিল মোহাম্মদ। আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল লাশের স্তূপ। হয়তো আজ মোহাম্মদও বেঁচে থাকত না। কিন্তু ইসরাইলের নৃশংসতা মুছে ফেলতে পারেনি গাজার ফিলিস্তিনিদের মধ্যে থাকা মানবতা। ইসরাইলের গোলাগুলির মধ্যেই তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে এনেছে রক্তের সম্পর্কহীন এক অপরিচিত পরিবার। এরপর কেটে গেছে ১৬ মাস। দীর্ঘ এই সময়ে যেন চিরচেনা হয়ে উঠেছে অচেনা দুই পরিবার। মা হারানো মোহাম্মদ এখন মায়ার বন্ধনে বাঁধল দুই পরিবারকে। আল-জাজিরা।
ঘটনার শুরু ১৬ মাস আগে। ইসরাইলের তাণ্ডব কেবলই শুরু হয়েছে অবরুদ্ধ গাজায়। তাদের আগ্রাসনের মুখে একটি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিল মোহাম্মদের পরিবার। সেই স্কুলে বোমা হামলা চালান ইসরাইলি সেনারা। মাত্র ১৩ মাস বয়সি মোহাম্মদ তার মায়ের নিথর দেহের পাশে বসে কাঁদছিল। সেদিন বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলো আতঙ্ক আর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে পালাচ্ছিল। হট্টগোলের মাঝে মোহাম্মদকে তার পরিবার হারিয়ে ফেলে। কিন্তু ছোট্ট এই শিশুটির জন্য দূত হয়ে আসে রাসেম নাবহান ও তার পরিবার। উত্তর গাজার জাবালিয়ায় আল-রাফেই স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিল তারা। সেখানে বোমা হামলা চালায় ইসরাইলিরা। মুহূর্তেই বাড়তে থাকে লাশ। কিন্তু পরিস্থিতি ঠিক হলে রাসেম দৌড়ে দগ্ধ শ্রেণিকক্ষগুলোতে ফিরে যান আগুন নেভাতে এবং কেউ বেঁচে আছে কি না, সেটি দেখতে। রাসেম বলেন, ‘দেওয়ালগুলো রক্তে ভিজে গিয়েছিল। আহত ও নিহত ব্যক্তিদের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল। ওই দৃশ্য ভাষায় বর্ণনা করার মতো না।’
এ গাজার বাসিন্দা বলেন, ‘এই বিভীষিকার মধ্যেই আমি দেখতে পেলাম, এক শিশু কাঁদছে। তার পাশে পড়ে আছে এক নারীর দেহ। তার মাথা আর পেট ছিন্নভিন্ন। শরীর রক্তে ভেজা। মনে হলো, ওই নারীই শিশুটির মা।’ কিছু না ভেবেই রাসেম শিশুটিকে তুলে নিয়ে ছুটে যান। তিনি বলেন, ‘শিশুটির মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। সে এত জোরে কাঁদছিল যে, দম নিতে পারছিল না।’ রাসেম বলেন, ‘আমি আশপাশের সবাইকে জিজ্ঞাসা করছিলাম, ‘এই শিশুকে কেউ চিন? তার মাকে মেরে ফেলা হয়েছে। কিন্তু কেউ চিনতে পারেনি। এটি ছিল দুঃসহ অভিজ্ঞতা। আমার কাছে মনে হয়েছিল কেয়ামত ঘটে যাচ্ছে। সন্তানদের আঁকড়ে ধরে সবাই ছুটে পালাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি শিশুটিকে আমার স্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে বললাম, তাকে আমি স্কুলে পেয়েছি। তার মাকে মেরে ফেলা হয়েছে।’ রাসেমের স্ত্রী ৩৪ বছর বয়সি ফাওয়াকেহ নাবহান শিশুটিকে কোলে তুলে নেন। এভাবেই রাসেম দম্পতির মানবিকতায় বেঁচে যায় মোহাম্মদ। তার বাবা তারেক আবু জাবাল এক বছরেরও বেশি সময় ধরে মোহাম্মদকে খুঁজে বেড়িয়েছেন। একদিন সাংবাদিকদের দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাসেম শিশুটিকে ফিরে পাওয়ার ঘটনা তুলে ধরেন। সেই প্রচারটি দেখতে পান মোহাম্মদের বাবা জাবাল। অবশেষে ২৭ জানুয়ারি যখন বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোকে উত্তর গাজায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়, তখন আবু জাবাল হেঁটে জাবালিয়ায় ফিরে আসেন এবং নিজের ছেলেকে কাছে ফিরে পান। তিনি বলেন, ‘মোহাম্মদের চেহারায় তেমন পরিবর্তন হয়নি। শুধু একটু বড় হয়েছে। আমি ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করছিলাম, আমার ছেলে বেঁচে আছে! আমার ছেলে মোহাম্মদ বেঁচে আছে! মোহাম্মদকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর রাসেম বলেন, ‘মনে হচ্ছিল নিজের আত্মার একটা অংশ ছেড়ে দিচ্ছি। সবচেয়ে কষ্টের মুহূর্ত ছিল, যখন ও চলে যাচ্ছিল আর কাঁদতে কাঁদতে আমাকে ‘বাবা’ ‘বাবা’ বলে ডাকছিল।