ঢাকা শুক্রবার, ১৭ই মে ২০২৪, ৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


চাঁদাবাজি করেই অঢেল সম্পদের মালিক রাজীব


১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৮:২৫

আপডেট:
১৭ মে ২০২৪ ২১:১৪

চাঁদাবাজি করেই অঢেল সম্পদের মালিক রাজীব

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গত বছর র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের বহিষ্কৃত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তারেকুজ্জামান রাজীবের (৩৮) অঢেল সম্পদের সন্ধান পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

সিআইডির ভাষ্য, সংঘবদ্ধভাবে চাঁদাবাজি, ভূমিদস্যুতা, গরুর হাটে টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ছিলেন রাজীব। তার এসব অপরাধের সহযোগী ছিলেন শাহ আলম হোসেন জীবন, কামাল, নুর মোহাম্মদ, রুহুল আমিনসহ আরও ১০ থেকে ১২ জন।

তাদের মাধ্যমেই তার নিয়ন্ত্রণাধীন মোহাম্মদপুর বিআরটিএ বাস স্ট্যান্ড, বছিলা বাস স্ট্যান্ড, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ চৌরাস্তা থেকে সøুইচগেট পর্যন্ত রোডের দুই পাশের অবৈধ ফুটপাত, সরকারি জমির ওপর অবৈধ দোকান, টেম্পোস্ট্যান্ড, অটোরিকশা স্ট্যান্ড, ইজিবাইক স্ট্যান্ড, ট্রাক স্ট্যান্ড, পিকআপ স্ট্যান্ড ও সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা চাঁদা তুলতেন রাজীব।

অবৈধ উপায়ে অর্জিত এসব টাকা নিজ ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে জমার তথ্য পেয়েছে সিআইডি। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে রাজধানীর ৪টি ব্যাংকের ৪ হিসাবে ২২ কোটি ৬২ লাখ ৭৫ হাজার ৩৬৫ টাকা জমার তথ্য পেয়েছে সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্টরা।

১২ ফেব্রুয়ারি ডিএমপির মোহাম্মদপুর থানায় সিআইডি বাদী হয়ে রাজীব ও তার চার সহযোগীর বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলা করেছে।

মামলার বাদী সিআইডির উপপরিদর্শক জায়েদ আলী জাহিদ জানান, সিআইডির ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষের নির্দেশে তারেকুজ্জামান রাজীবের অর্থ পাচারের অপরাধ সংঘটনের বিষয়ে অনুসন্ধান করি।

অনুসন্ধানে সংঘবদ্ধভাবে চাঁদাবাজি, ভূমিদস্যুতা, গরুর হাটে টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে অর্থ আয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

ফলে অপরাধলব্ধ আয় জ্ঞাতসারে গ্রহণ, ভোগদখল, ব্যাংক হিসাবে জমা ও স্থানান্তর এবং জমি ও ফ্ল্যাটে রূপান্তর করা ও সহযোগিতা করায় রাজীব ও তার চার সহযোগীর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ (সংশোধনী ২০১৫)-এর ৪ (২) ধারায় মামলা করা হয়েছে।

মোহাম্মদপুর থানায় করা মামলার এজাহার ও সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিএনসিসির চাঁন মিয়া হাউজিংয়ের ২ নম্বর রোডের

চাঁন কমিউনিটি সেন্টারের দ্বিতীয় তলায় কাউন্সিলর কার্যালয় স্থাপন করেন রাজীব। সেখানে ২০১৫ সালের ১ জুন থেকে ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত তার সহযোগীরা সংঘবদ্ধভাবে এলাকার নানা অপরাধমূলক কাজ পরিচালনা করতেন।

অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণে রাজীবের প্রধান সহযোগী ছিলেন শাহ আলম হোসেন জীবন, নুর মোহাম্মদ ও রুহুল আমিন। কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পরবর্তী ৫ বছরে তারেকুজ্জামান রাজীব বছিলা তিন রাস্তার মোড় ও মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় প্রতি বছর কোরবানির পশুর হাটের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণসহ প্রকাশ্যে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত ছিলেন।

জনৈক রুহুল আমিনের সহযোগিতায় ঢাকা উদ্যান, চাঁদ উদ্যান, নবীনগর, তুরাগ, একতা হাউজিং এলাকায় অটোরিকশা চলার জন্য কাঞ্চন, হৃদয়, মিলন, সেন্টু, মিজান ও রুবেলের মাধ্যমে প্রতি মাসে প্রায় ১৫ লাখ টাকা চাঁদা তুলতেন।

এ ছাড়া জীবন বিভিন্ন বাস স্ট্যান্ড থেকে চাঁদাবাজির মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় লাখ টাকা এবং অটোরিকশা চলাচলের জন্য প্রতি মাসে প্রায় ১০ লাখ টাকা চাঁদা তুলত। রাজীব কাউন্সিলর পদে দায়িত্ব নেওয়ার পর নামিয়া এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের আড়ালে জমি দখল ও বিক্রি করেছেন। রাজীবের প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় সহযোগী নুর মোহাম্মদ ঢাকা উদ্যান এলাকায় অন্যের জমি জোর করে দখল এবং কাউন্সিলর অফিসে ভুক্তভোগীদের ডেকে এনে ভয়ভীতি দেখিয়ে স্বল্পমূল্যে জমি বিক্রির জন্য বাধ্য করত।


তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত রাজীবের নিজ ও প্রতিষ্ঠানের নামের চারটি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে মোট ২২ কোটি ৬২ লাখ ৭৫ হাজার ৩৬৫ টাকা জমা হয়। বর্তমানে ব্যাংক হিসাবগুলোয় স্থিতির পরিমাণ ১ কোটি ৪৬ লাখ ৭৭ হাজার ১৯২ টাকা।

এর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকের মোহাম্মদপুর শাখায় নামেরা এন্টারপ্রাইজ নামীয় ১৫৪৩২০৩৫০৭৪০১০০১ নম্বর হিসাবে মোট ২১ কোটি ৫৭ লাখ ৫২ হাজার ৩৬৫ টাকা জমা হয়। হিসাবটিতে বর্তমানে স্থিতির পরিমাণ ৯৬ লাখ ৭৪ হাজার ৮৩ টাকা।

বাংলাদেশ কমিউনিটি ব্যাংকের করপোরেট ব্রাঞ্চ গুলশানে নামেরা বিল্ডার্স লি. ০০১০৩০০২০৩১০১ নম্বর হিসাবে ১ কোটি ৫০০ টাকা জমা হয়। হিসাবটিতে বর্তমানে স্থিতির পরিমাণ ৫০ লাখ ৩৮০ টাকা। ন্যাশনাল ব্যাংকের মোহাম্মদপুর ব্রাঞ্চে তারেকুজ্জামান নামীয় ১০১৮০০০৬৪১৫০৪ (নতুন) নম্বর হিসাবে ৬ লাখ ২০ হাজার ৫০০ টাকা জমা হয়। যার বর্তমান স্থিতির পরিমাণ ১ হাজার ২৯৫ টাকা।

জনতা ব্যাংকের রায়েরবাজার ব্রাঞ্চে তারেকুজ্জামান রাজীব নামের ০১০০০১৮০৪২৮৬৪ নম্বর হিসাবের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এ ছাড়া অবৈধ পথে অর্জিত অর্থ দিয়ে বাড়ি, ফ্ল্যাট, জমি ক্রয় ও নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠান চালু করে বিভিন্ন ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তর করেছে, যার পরিমাণ ১৮ কোটি ৪০ লাখ ২৭ হাজার ১৯২ টাকা।

শ্যামলাপুর ওয়েস্টার্ন সিটি লিমিটেডের পরিচালক রাজীবের সিলিকন হাউজিং লিমিটেডে ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকার শেয়ার রয়েছে।

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে রাজীবের নামে ২০১৯ সালের ১ জুন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করে। এ ছাড়া র‌্যাব বাদী হয়ে ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর রাজধানীর ভাটারা থানায় মাদক ও অস্ত্র আইনের মামলা করে।

সর্বশেষ ১২ ফেব্রুয়ারি ডিএমপির মোহাম্মদপুর থানায় সিআইডি বাদী হয়ে রাজীব ও তার চার সহযোগী শাহ আলম হোসেন জীবন, কামাল, নুর মোহাম্মদ ও রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলা দায়ের করেছে। ২০১৯ সালের ১৯ অক্টোবর রাতে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ৪ নম্বর রোডের ৪০৪ নম্বর বাড়ি থেকে রাজীবকে আটক করে র‌্যাব। তিনি এখন জেলে রয়েছেন।