ঢাকা মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল ২০২৪, ১৮ই বৈশাখ ১৪৩১


প্রতারণার ফাঁদে সেলেব্রিটিরা


২৪ জানুয়ারী ২০২১ ১৭:৩৬

আপডেট:
৩০ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:০৮

। ভেরিফিকেশনের নামে তথ্য নিয়ে আইডির পাসওয়ার্ড ও ইউজার নেইম বদলে ওই আইডিতে নগ্ন ছবি ও ভিডিও পোস্ট করায় আইডির প্রকৃত স্বত্বাধিকারীরা বিব্রত হওয়ার পাশাপাশি প্রতারক চক্রগুলো চড়া দামে এসব আইডি বিক্রি করছে উত্তর আফ্রিকার বেশকিছু দেশের প্রতারকদের কাছে। প্রতারক চক্রগুলোর ফাঁদে পড়ে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি সামাজিকভাবেও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন সমাজে প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় অনেক ব্যক্তি। গত শুক্রবার রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় হৃদয় আহম্মেদ নামে এক ব্যক্তির অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্তে নেমে এমন অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ।

ডিবি কর্মকর্তারা জানান, গত শুক্রবার রাতে নরসিংদীর গ্রামের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে একটি প্রতারক চক্রের হোতা মো. সৈকত মিয়াকে গ্রেপ্তার করে তাদের একটি দল। সৈকত মিয়া ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। তিনি ২০১২ সালের শেষের দিকে ফেইসবুককেন্দ্রিক প্রতারণার কাজে জড়িয়ে পড়েন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর বনানী থানা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি মেহেদী হাসান শাওনের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ফেইসবুককেন্দ্রিক প্রতারণা চক্র। তিনি ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে মৌখিক অভিযোগও করেছেন। মেহেদী হাসান শাওন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার কাছ থেকে ফেইসবুক আইডি ব্লু ভেরিফাইডের কথা বলে ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারকরা। তবে আইডি হ্যাক করতে পারেনি।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, অপরাধের ধরন প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। অপরাধীরা প্রচলিত অপরাধ থেকে সাইবার ক্রাইমের দিকে ঝুঁকছে। দেশে সাইবার ক্রাইম বলতে সাধারণ মানুষ বোঝে ফেইসবুককেন্দ্রিক অপরাধ। ফেইসবুকে এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ বা তারও বেশি ফলোয়ার থাকা জনপ্রিয় ব্যক্তিদের নাম ভাঙিয়ে ২০ থেকে ২৫টি পর্যন্ত ফেইসবুক আইডি তৈরি হচ্ছে। ফলে ওই সব জনপ্রিয় ব্যক্তিদের ফলোয়াররা কোনটি আসল আর কোনটি নকল অ্যাকাউন্ট তা চিহ্নিত করতে গিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে যান। আর এই সুযোগে প্রতারণার বিশাল জাল বিস্তার করেছে প্রতারকরা। জনপ্রিয় ব্যক্তিদের (ন্যূনতম ১০ হাজার ফলোয়ার) প্রতারণা থেকে বাঁচাতে ফেইসবুকের একটি অপশন রয়েছে। যার নাম ‘ব্লু ভেরিফাইড ব্যাজ’, এটি সংশ্লিষ্টআইডি প্রকৃত জনপ্রিয় ব্যক্তির কি না তা বোঝার একটি ব্যবস্থা। এসব ব্লু ভেরিফাইড আইডির নামের পাশে নীল বা হালকা কালো রঙের একটি টিক চিহ্ন থাকে। ফেইসবুকে নীল বৃত্তাকারে সাদা এই টিক চিহ্নকে বলা হয় ব্লু-ব্যাজ।

ডিবি কর্মকর্তারা জানান, এই ব্লু-ভেরিফাইড ব্যাজের নামে প্রতারণা চক্রগুলোর মধ্যে একটির হোতা সৈকত মিয়া উত্তর আফ্রিকার দেশ মিসর, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, আলজাজিরা ও মরক্কোয় কিছু চক্রের কাছ থেকে ব্লু-ভেরিফাইড ফেইসবুক আইডি কিনে তা ব্যবহার করে ছদ্মনামে প্রতারণা করে আসছিল। বাংলাদেশে অবস্থান করে তিনি নিজেকে কানাডার নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতেন। প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া আইডি চড়া দামে বিক্রি করে দিতেন সৈকত। দেশের অনেক ব্যবসায়ী, চিকিৎসক ও জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও ফাঁদে ফেলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এই সৈকত মিয়া। তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই ডিবির নজরদারিতে ছিলেন। গত শুক্রবার রাতে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাকে নরসিংদীর গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের সোশ্যাল মিডিয়া ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মনিরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কোনো কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তার ফেইসবুক আইডি বা পেইজ ‘ব্লু ভেরিফাইড’ করার জন্য তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ফেইসবুকের কাছে যে আবেদন করে থাকেন। তবে এক্ষেত্রে ওই তৃতীয় পক্ষের অধিকাংশই প্রতারক। সুতরাং যখন কোনো আইডি বা পেইজ ব্লু ভেরিফাইড করার জন্য গ্রাহকের ইউজার নেইম ও পাসওয়ার্ড তৃতীয় পক্ষ চান তখন তা দেওয়ার আগে অবশ্যই যাকে দেওয়া হচ্ছে তার সম্পর্কে জানতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীকে সচেতনতা ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কেউ চাইলেই তার আইডি বা পেইজ ব্লু ভেরিফাইড করতে পারে না। এক্ষেত্রে সাধারণত কোনো ব্যক্তির নামে বড় একটি আর্টিকেল যখন উইকিপিডিয়াতে একসেপ্ট হয়, তিনি যে পেইজ বা আইডি থেকে আর্টিকেলটি লিখলেন তার ফলোয়ার যদি নিম্নত ১০ হাজার থাকে, তখন তিনি এলাকাভেদে ১০০ থেকে ৫০০ ডলার দিয়ে ফেইসবুকের থার্ড পার্টির মাধ্যমে তার আইডি বা পেইজটি ফেইসবুকের কাছে ব্লু ভেরিফাইডের জন্য রিকোয়েস্ট পাঠায়। ফেইসবুক তখন এটিকে সত্য মনে করে ভেরিফাই করে দেয়। মিসরের যারা এই চক্রে আছে তারা আমাদের দেশে বা ইনডিয়ান সাবকন্টিনেন্টে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে, এরা ওই যে আইডিটা ভেরিফাইড করা হয়েছে ব্লু ভেরিফাইড হিসেবে ওই আইডিটা নাম চেঞ্জ করে ৪০০ থেকে ৫০০ ডলারে বিক্রি করে দেয়।’

প্রতারণার শিকার হৃদয় আহম্মেদ জানান, ঢাকার মিরপুরে তার বাসবাস। নিজের ফেইসবুক আইডি ‘হৃদয় আহম্মেদ’-এ ৬৭ হাজার ফলোয়ার রয়েছে। এই আইডি থেকে দেখেন ‘চার্লস অ্যানড্রেস ব্রেইন’ নামে একটি ফেইসবুক আইডি থেকে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে যে এক হাজার টাকার বিনিময়ে ফেইসবুকের বিশেষ সিকিউরিটি হিসেবে ব্লু ভেরিফাই করা হয়। মেসেঞ্জারের মাধ্যমে ওই আইডির সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার। ব্লু ভেরিফাই করার জন্য তার ফেইসবুকের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দেয় চার্লস অ্যানড্রেস ব্রেইন নামের ওই ফেইসবুক আইডিধারীকে। পরে হৃদয়কে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ১০ হাজার টাকা পাঠানোর কথা জানানো হয়। এরপর তার আইডিটির দখল নিয়ে নেয় প্রতারক চক্রটি।

ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতারক চক্রগুলো ফেইসবুক আইডি বা পেইজ ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা চালুর নামে শত শত মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। প্রতিদিনই অসংখ্য অভিযোগ আসছে তাদের কাছে। অনেক ক্ষেত্রে ওইসব ব্যক্তির আইডির নাম পাল্টে ফেলছে চক্রটি।

যেভাবে সৈকতের প্রতারণা শুরু : জিজ্ঞাসাবাদে সৈকত ডিবি কর্মকর্তাদের বলেছেন, মিসরের একটি চক্রের কাছ থেকে তিনি একটি ব্লু ভেরিফাইড আইডি ৪০০ ডলারে কিনে নেন। পরে সেই আইডিটার নাম দেন ‘চার্লিস এনড্রিয়ার্স ব্রিন’। তিনি নিজেকে কানাডার নাগরিক পরিচয় দিয়ে সবার বিশ্বাস অর্জন করেন। সৈকত এই আইডি ব্যবহার করে অন্যের ফেইসবুক আইডি ব্লু ভেরিফাইড করে দেবেন বলে বিজ্ঞাপন দেন। তার ওই আইডিতে লেখেন, ‘ব্লু ভেরিফাইড সার্ভিস এভেল এভেল, প্রাইস অ্যান্ড ডিটেইলস ইনবক্স’।