নারায়ণগঞ্জে ৭ খুন
১১ বছরেও শেষ হয়নি চূড়ান্ত বিচার

পার হলো ১১ বছর অথচ নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা মনে পড়লে এখনো বিভীষিকা ঘিরে ধরে। ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস হত্যার ঘটনা ট্রমায় ফেলেছিল পুরো দেশকে। একে একে সাতজনকে প্রথমে অপহরণ ও গুম পরে নির্মমভাবে হত্যা করে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেওয়া হয় লাশ। দেশকে নাড়িয়ে দেওয়া এ ঘটনায় ব্যাপক তোলপাড় হয়। আসামিদের দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি তোলে মানুষ। কিন্তু ১১ বছরেও সাত খুন মামলার চূড়ান্ত বিচার নিষ্পত্তি হয়নি। আজ সেই ভয়ংকর ২৭ এপ্রিল।
এ মামলায় ২০১৭ সালে বিচারিক আদালতে ২৬ জনের ফাঁসির রায় হয়। একই বছর ২৬ আসামির মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদ- বহাল রেখে এবং অন্য ১১ আসামির সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন সাজার রায় দেয় হাইকোর্ট। হাইকোর্টের রায়ের পর সাড়ে ৭ বছরের বেশি সময় ধরে মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতে কবে নাগাদ এ মামলার শুনানি শুরু হবে, কবে নিষ্পত্তি হবে, সে বিষয়ে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের তরফে কোনো ধারণা মেলেনি।
যা ঘটেছিল ১১ বছর আগে
আলোচিত এ মামলার অভিযোগপত্র, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও সাক্ষীদের বক্তব্য থেকে নৃশংস এ ঘটনার বিবরণ উঠে আসে। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল। দুপুরে ঢাকা- নারায়ণগঞ্জের লিংক রোডের লামাপাড়া এলাকায় র্যাবের সদস্যরা চেকপোস্ট বসিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র মো. নজরুল ইসলাম, তার তিন সহযোগী ও গাড়িচালককে তুলে নিয়ে যান। ঘটনার সময় একই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন নজরুলের আইনজীবী চন্দন সরকার। তিনি অপহরণের বিষয়টি আঁচ করতে পেরে চিৎকার করায় তাকে (চন্দন সরকার) ও তার গাড়িচালককেও তুলে নিয়ে যায় র্যাব। পরে সাতজনের মুখম-লে পলিথিন পেঁচিয়ে শ^াসরোধে সবাইকে হত্যা করা হয়। একপর্যায়ে নিহতদের পেট কেটে লাশের সঙ্গে ইটের বস্তা বেঁধে লাশ ডুবিয়ে দেওয়া হয় শীতলক্ষ্যা নদীতে।
৩০ এপ্রিল ছয়জন ও পরদিন আরও এককজনের লাশ নদীতে ভেসে ওঠে। নির্মমতায় যারা অপহরণ ও খুন হন, তারা হলেন নজরুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট চন্দন সরকার, নজরুলের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, নজরুলের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম।
সাত খুনে নারায়ণগঞ্জসহ সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। সিদ্ধিরগঞ্জে বিক্ষুব্ধ জনতা ঘটনার সন্দেহভাজন ও মূলহোতা হিসেবে সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগ সহসভাপতি ও নাসিকের ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর (পরে বরখাস্ত) নূর হোসেনের রাজনৈতিক কার্যালয় পুড়িয়ে দেয়। হত্যার বিচারের দাবিতে নজরুলের অনুসারী ও এলাকাবাসী ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে। তবে, ঘটনার পরপরই পালিয়ে যান নূর হোসেন (২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর তাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়)। এ ঘটনায় র্যাব-১১-এর তখনকার অধিনায়ক লে. কর্নেল (পরে বরখাস্ত) তারেক সাঈদ মোহাম্মদসহ বাহিনীটির কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নূর হোসেনের সঙ্গে যোগসাজশ করে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অপহরণ ও হত্যার অভিযোগ ওঠে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে নজরুলকে খুনের পরিকল্পনায় র্যাবকে ব্যবহার করেন নূর হোসেন। হত্যাকান্ডে র্যাবের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে এই বাহিনী। তারেক সাঈদ আওয়ামী লীগ নেতা ও তখনকার ত্রাণ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা। এ নিয়ে তখন সরকারে থাকা আওয়ামী লীগেও তোলপাড় শুরু হয়।
যেভাবে বিচারিক আদালতের রায়
সাতজনের লাশ পাওয়ার ঘটনার এক দিন পর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে ছয়জনের নাম উল্লেখ করে ফতুল্লা থানায় অপহরণ ও হত্যা মামলা করেন। অন্যদিকে চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম হত্যার ঘটনায় ১১ মে একই থানায় আরেকটি মামলা করেন চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল। অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর পর সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্কের শুনানি নিয়ে ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন রায় দেন। রায়ে যে ২৬ আসামিকে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়, তাদের মধ্যে ১৬ জনই র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সদস্য।
বিচারিক আদালতে ফাঁসির সাজা পাওয়া র্যাব-১১-এর সাবেক কর্মকর্তারা হলেন তারেক সাঈদ, মেজর (বরখাস্ত) আরিফ হোসেন ও লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (বরখাস্ত) মাসুদ রানা। এ ছাড়া হাবিলদার এমদাদুল হক, আরওজি-১ আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, এসআই পূর্ণেন্দ বালা, সিপাহি আবু তৈয়ব, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, সৈনিক আবদুল আলীম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি, সৈনিক আসাদুজ্জামান নূর, সৈনিক আল আমিন, সৈনিক তাজুল ইসলাম ও সার্জেন্ট এনামুল কবীর। এই সাজাপ্রাপ্তদেরও চাকরিচ্যুত করা হয়।
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত অন্যরা হলেন সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, তার সহযোগী মিজানুর রহমান দীপু, রহম আলী, আলী মোহাম্মদ, আবুল বাশার, মোর্তুজা জামান চার্চিল, সেলিম, সানাউল্লাহ সানা, ম্যানেজার শাহজাহান ও ম্যানেজার জামাল উদ্দিন। এ ছাড়া বিচারিক আদালতে অপহরণ ও আলামত গোপনের অভিযোগে র্যাবের আরও ৯ জনকে ৭ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ-াদেশ দেয় বিচারিক আদালত।
হাইকোর্টের রায়ে ১৫ জনের ফাঁসি বহাল
বিচারিক আদালতের রায়ের কিছুদিনের মধ্যে মৃত্যুদ-প্রাপ্তদের নথি হাইকোর্টে পাঠানো হয়, যা ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদন্ড অনুমোদন) হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। পাশাপাশি তারেক সাঈদ, নূর হোসেনসহ দন্ডপ্রাপ্ত ২৮ আসামি হাইকোর্টে আপিল করেন। মামলাটি হাইকোর্টে নিষ্পত্তি হয় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। শুনানি নিয়ে ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ ১৫ আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে রায় দেয়। পাশাপাশি মৃত্যুদন্ড কমে যাবজ্জীবন সাজা হয় ১১ জনের।
হাইকোর্টের রায়ে যাদের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে তারা হলেন তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, আরিফ হোসেন, এম মাসুদ রানা, নূর হোসেন, বেলাল হোসেন, মো. এমদাদুল হক, আরিফ হোসেন, হিরা মিয়া, আবু তৈয়ব আলী, মো. শিহাব উদ্দিন, পূর্ণেন্দু বালা, আবদুল আলিম, মহিউদ্দিন মুনশি, আল আমিন ও তাজুল ইসলাম। মৃত্যুদন্ড কমে যাদের যাবজ্জীবন হয়, তারা হলেন আসাদুজ্জামান নুর, এনামুল কবির, আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান, রহম আলী, আবুল বাশার, মোর্তুজা জামান চার্চিল, সেলিম, সানাউল্লাহ সানা, শাহজাহান ও জামালউদ্দিন। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের বিচারিক আদালত যে ৯ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়, হাইকোর্টের রায়ে তাদের সাজাও বহাল থাকে। ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে, পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর তারেক সাঈদ, নূর হোসেন, আরিফ হোসেন ও মাসুদ রানাসহ কারাগারে থাকা আসামিরা আপিল করেন। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলেন, আসামিপক্ষের আবেদনের ভিত্তিতে, রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে কিংবা আপিল বিভাগ নিজ উদ্যোগে (সুয়োমোটো) আপিল শুনানির উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগের খবর পাওয়া যায়নি।
আসামি নূর হোসেনের আইনজীবী এস আর এম লুৎফর রহমান বলেন, ‘হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পরই আমরা আপিল বিভাগে আপিল করেছিলাম। আমরা আমাদের আইনি কাজটুকু করেছি। এখন রাষ্ট্রপক্ষ শুনানির উদ্যোগ নিতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট যদি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির নির্দেশ দেয়, সেটিও হতে পারে।’ তিনি জানান, আপিল বিভাগে এখন ২০১৪ সালের (হাইকোর্টের রায়) ক্রমানুসারে মামলার শুনানি চলছে। আপিল শুনানির বিষয়ে জানতে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও তার সাড়া মেলেনি।
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ বলেন, ‘আপিল বিভাগে মামলা আসে ক্রমানুসারে। আমরা তো চাইব দ্রুত শুনানি করতে। কিন্তু এটা তো নির্ভর করে প্রধান বিচারপতির ওপর। আর আদালতের কিছু শৃঙ্খলা ও নিয়মের বিষয় আছে। আপাতত বলতে পারি, যেহেতু ক্রমানুসারে আসবে, তাই সেভাবেই শুনানি হবে।’