ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ১৫ই মে ২০২৫, ২রা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২


সুপ্রিম কোর্ট বার

অ্যাডহক কমিটির নেতৃত্বে আর কতদিন


১৫ মে ২০২৫ ১৬:৪১

আপডেট:
১৫ মে ২০২৫ ২২:৩১

অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি দিয়ে চলছে সুপ্রিম কোর্ট বার। দীর্ঘ আট মাস পার হলো। কিন্তু বারের নির্বাচনের আবহ দেখা যাচ্ছে না। জুলাই বিপ্লবের পর সরকার পরিবর্তন হলে ভাটা পড়ে যায় সুপ্রিম কোর্ট বারের ভোট অনুষ্ঠান। এমন অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চান সাধারণ আইনজীবীরা।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্বাচিত কমিটি না থাকায় কবে নাগাদ কীভাবে ভোট অনুষ্ঠিত হবে, সেটি সিদ্ধান্ত হবে বিশেষ সাধারণ সভায়।

সর্বশেষ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০২৪ সালের ১০ মার্চ। সে সময় সভাপতি হিসেবে বিএনপি সমর্থিত এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন ও আওয়ামী সমর্থিত শাহ মঞ্জুরুল হক সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন।

এক বছর মেয়াদের এ ভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ২০২৫ সালের মার্চ মাসে। কিন্তু দুই মাস পার হয়ে গেলেও ভোট অনুষ্ঠানের কোনো সাড়া শব্দ নেই। কেন নির্বাচন হচ্ছে না, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন মার্চ মাসে ভোট অনুষ্ঠানের কথা ছিল। কিন্তু হয়নি কারণ তখন রোজা ছিল।

তারা আরও বলছেন, বিশেষ সাধারণ সভা ডেকে সুপ্রিম কোর্ট বারের ভোট অনুষ্ঠানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। প্রতি বছরের মার্চ মাসে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু রোজার কারণে ভোট হয়নি। যেহেতু নির্বাচিত কমিটি নেই, তাই বিশেষ সাধারণ সভা ডেকে অনবর্তীকালীন কমিটি গঠন করা হয়েছে। যে কমিটিই হোক না কেন, সেটা বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম)’র মাধ্যমে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সমিতির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভোট অনুষ্ঠানের বিষয়ে সব ধরনের সিদ্ধান্ত নেবেন সম্পাদক। সামনের অবকাশকালীন ছুটি শেষে সমিতির বিশেষ সাধারণ সভা ডাকা হবে। সেই সাধারণ সভায় সুপ্রিম কোর্ট বারের ভোট কবে অনুষ্ঠিত হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সুপ্রিম কোর্ট বারের বর্তমান কমিটির সভাপতি ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘আমরা বিশেষ সাধারণ সভা ডেকে অ্যাডহক কমিটি করেছিলাম। যখন ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন তখন সারাদেশে সংকট পড়ে যায়। সুপ্রিম কোর্ট বারও নেতৃত্বের সংকটে পড়ে যায়। তখন আইনজীবীরা বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) করে অ্যাডহক কমিটি করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘অ্যাডহক কমিটির মেয়াদ আট মাস চলে। নির্বাচনের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব হচ্ছে বারের সম্পাদকের। তিনি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে গঠনতন্ত্র ফলো করবেন। আমি মনে করি সামনে সুপ্রিম কোর্ট অবকাশকালীন ছুটিতে যাচ্ছে। ছুটির পর একটি বিশেষ সাধারণ সভা ডেকে নির্বাচনের সময় তারিখ ঘোষণা করা হতে পারে ‘

সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাডহক কমিটি দিয়ে চলছে। বিগত সরকারের সময় আওয়ামী সমর্থিতরা অবৈধভাবে কব্জা করে রেখেছিল। ফ্যাসিস্টরা পালানোর পর অ্যাডহক কমিটি দিয়ে সমিতি চলছে।’

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনতো অবশ্যই হওয়া দরকার। নির্বাচিত নেতারাই বার পরিচালনা করবেন। আমি আশা করি একটা রিজনেবল সময়ের মধ্যে এডহক কমিটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন।’

সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভোগের সাবেক বিচারপতি ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এবিএম আলতাফ হোসেন বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট বারে একটি ভালো গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন দরকার। যেটি বিগত কয়েক বছর হয়নি। বিগত কয়েক বছরের নির্বাচন নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক ও সমালোচনা রয়েছে। নির্বাচন হলে আইনজীবীদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়বে। পারস্পারিক সম্পর্ক বৃদ্ধি হবে। অনেকদিন হলো অ্যাডহক কমিটি দিয়ে সমিতি চলছে। নির্বাচিত একটি কমিটি আইনজীবীরা চাচ্ছেন।’

এ ব্যাপারে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল বলেন, ‘ভোট অবশ্যই দরকার এবং ভোট এবং আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। গণতন্ত্রের জন্যই আমরা গত ১৭ বছর সংগ্রাম করেছি। আপনি এই অঙ্গনের লোক। আপনি জানেন গত চার পাঁচ বছর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা ভোট দিতে পারেন নাই। এক রকম জবরদস্তি করেই তারা বার নিয়ন্ত্রণ করেছে। গত ৫ আগস্ট তাদের নেত্রী হেলিকপ্টারে পালিয়ে যাওয়ার পরে তাদের আর কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘বার তো একটা অভিভাবক ছাড়া থাকতে পারেন না। যারা সেই সময়ে উনাদের (আওয়ামী) সঙ্গে নির্বাচন করেছিলেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন সভাবতই তারা ভোটে পারতেন। নির্বাচন হলে উনারাই (বিএনপি সমর্থিতরা) পারতেন। আমরা সেটাই মনে করি। আইনজীবীরাও সেটাই মনে করে। সুতরাং বারের স্বার্থে বারের আইনজীবীদের স্বার্থে আমরা একটি অ্যাডহক কমিটি করেছি। হ্যাঁ সত্যিই অ্যাডহক কমিটির মেয়াদ এতো লম্বা হতে পারে না। আমরা ভোটের জন্য একটা সমাধান বের করার চেষ্টা করছি। আপনারা দেখতে পারবেন খুব সহসাই সুপ্রিম কোর্ট বার নির্বাচনি আমেজে ফিরবে।’

সুপ্রিম কোর্ট বারের ভোট আয়োজনের জন্য বিশেষ সাধারণ সভা বা ইজিএমের প্রয়োজন পড়ে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আছে। যেহেতু মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এজিএম বা ইজিএম যাই হোক একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই ভোট অনুষ্ঠিত হবে। উৎসবমুখর পরিবেশে বারের ভোট অনুষ্ঠিত হবে।’

দেশের কোথাও কোথাও আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে আওয়ামী সমর্থিতরা ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। এ কারণে ভোটে আপনাদের অনীহা আছে কি না— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে গণতন্ত্র নিয়ে কোনো ভয় নাই। নির্বাচন হবে, যদি সাধারণ ভোটাররা মনে করে ভোট যাকে খুশি দেবেন। ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ উনারা (আওয়ামী লীগ) কোন প্যানেলে নির্বাচন করবেন সেটা তাদের ব্যাপার। সাধারণ ভোটাররা যদি তাদেরকে ভোট দেয় তাহলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি নেই এই কারণে যে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হচ্ছে ভোট। সুতরাং আমাদের ভোট নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নাই। সাধারণ আইনজীবীরা যাকে বেছে নিবে তাকেই ভোট দিতে পারবে।’

আপনাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্য কোনো ভোট চান না এমন বক্তব্য কি সঠিক? এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা একটা চরম ডাহা মিথ্যা কথা। এ ধরনের বক্তব্য উনি কখনেই দেন নাই। কখনো দেবেন বলে উনি বিশ্বাস করেন না। উনি আমাদেরকে গণতন্ত্রের পথে পরিচালিত করছেন। এমনও আছে যে আমাদের ইউনিয়ন কমিটি এমনকি ওয়ার্ড কমিটিও নির্বাচনের মাধ্যমে হচ্ছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হচ্ছে। সুতরাং আমার মনে হয় উনি গণতন্ত্রের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। উনি সব সময় চান বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ফিরে আসুক।’

‘সমস্ত বারগুলোতে তো ভোট হচ্ছে। হচ্ছে না, একটা বার দেখান যে যে বারের ভোট বন্ধ আছে। সব জায়গায় ভোট হচ্ছে। আপনার প্রশ্নের মধ্যেই আপনার উত্তর আছে। কিছু কিছু বারে ফ্যাসিস্টের দোসররা বিজয়ী হয়েছে। সুতরাং এমন প্রশ্ন অবান্তর যে আমরা জাতীয় নির্বাচনের আগে বারের ভোট চাই না।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপি সমর্থিত সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী বলেন, ‘আমরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অন্য কোনো নির্বাচন চাই না। আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক বর্ধিত সভায় বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অন্য কোনো ভোটে যাওয়া যাবে না।’

তবে জুলাই বিপ্লবের পর দেশের কোনো কোনো আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে আওয়ামী সমর্থিতরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এই ফলাফল তারা ফলাও করে প্রচার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে। এ বিষয়টিও ভালোভাবে নিচ্ছেন না বিএনপিপন্থিরা। তবে সুপ্রিম কোর্ট বারের ভোটের হিসাব ভিন্ন। এখানে আওয়ামী পন্থিদের বিরুদ্ধে ভোটে ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনায় মামলা-মোকাদ্দমা জেল জুলুম খেটেছেন কেউ কেউ।

সর্বশেষ ২০২৪ সালের ১০ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০২৪-২৫ সালের নির্বাচনে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপি সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন এবং সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থী শাহ মঞ্জুরুল হক।

নির্বাচনের ৪৪ ঘণ্টা পর গত বছরের ৯ মার্চ বিকেল ৩টার পর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০২৪-২৫ সালের নির্বাচনের ভোট গণনা শুরু হয়। ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে হট্টগোল ও হাতাহাতির ঘটনায় আগেরদিন ৮ মার্চ রাজধানীর শাহবাগ থানায় ২০ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হয়। হত্যাচেষ্টার অভিযোগে করা ওই মামলায় আরও ৩০-৪০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। এরপর ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর ৫ আগস্ট পালিয়ে যান সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তছনছ হয়ে যায় আওয়ামী সরকারের সব কিছুই। এমন বাস্তবতার প্রভাব পড়ে সুপ্রিম কোর্ট বারেও। এরপর বিশেষ সাধারণ সভা করে গঠন করা হয় বারের অ্যাডহক কমিটি। সেই কমিটি দিয়েই চলছে সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের এ সংগঠনটি।

আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা পালানোর পর নির্বাচন না হওয়ায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির (সুপ্রিম কোর্ট বার) অন্তর্বর্তী কার্যনিবাহী কমিটি গঠন করা হয়েছে। বারের বর্তমান সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকনকে অন্তর্বর্তী কার্যনিবাহী কমিটির সভাপতি এবং সমিতির ২০২৪-২০২৫ বর্ষের জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী ব্যারিস্টার মো. রুহুল কুদ্দুস (কাজল) কে সম্পাদক করা হয়েছে। পরে রুহুল কুদ্দুস কাজল দায়িত্ব গ্রহণ না করায় ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে ব্যারিস্টার মাহফুজুর রহমান মিলন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।