ঢাকা বুধবার, ৭ই মে ২০২৫, ২৫শে বৈশাখ ১৪৩২


দোটানায় নুর, সঙ্গীরা ক্ষুব্ধ


১৮ মার্চ ২০১৯ ২০:০২

আপডেট:
৭ মে ২০২৫ ১৭:৪৬

দোটানায় নুর, সঙ্গীরা ক্ষুব্ধ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন নিয়ে উভয় সংকটে পড়েছে নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুর। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন নাকি সাধারণ শিক্ষার্থী ও নির্বাচন বর্জনকারী প্যানেলগুলোর সঙ্গে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন- এ নিয়ে দোটানায় পড়েছেন বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের এই নেতা।

ভিপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন সময় মত পাল্টানোর ঘটনায় আন্দোলনকারী, সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে সমালোচনায় পড়েছেন নুর। নূরের প্যানেলের অন্য নেতারাও নূরের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। নুর না চাইলেও তার সংগঠন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ চায় কোটা আন্দোলনে তারা যে প্ল্যাটফরম তৈরি করেছে তা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। নুর ভিপির দায়িত্ব পালন করলেও সংগঠনের নেতারা আন্দোলনে থাকবেন। নুরকে তার প্যানেলের নেতারাও এই কথা জানিয়েছেন বলে জানা গেছে।

সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের এক নেতা গতকাল রাতে বলেন, ‘পদে থেকেই নুর আন্দোলন করবেন এমনটাই বলেছেন সংগঠনের সহকর্মীদের কাছে। কিন্তু বর্জনকারী অন্য প্যানেলগুলোর নেতারা এটি মানছে না। তারা চায় নুর নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিক।’ তিনি বলেন, গত শনিবার প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে গণভবনে গিয়ে নুর যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতেও আন্দোলনকারী প্যানেলের নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তাই তারা আমাদের সংগঠনকে বাদ দিয়ে আন্দোলনে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

নূরের সংগঠনের আরেক নেতা বলেন, গণভবনে বক্তব্য নিয়ে নুর তার সমর্থক ও ভোটারের মধ্যেও সমালোচনার মধ্যে পড়ে। মূলত ভোটারদের এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের মন রক্ষা করতেই গতকাল বিকেলে আবার আন্দোলনে ফিরে এসেছে নুর। তিনি জানান, ভিপি পদে থেকেই তিনি আন্দোলন চালিয়ে যেতে চান। নির্বাচনের অনিয়ম ও কারচুপি নিয়ে নুর প্রধানমন্ত্রীর সামনে তেমন কিছুই বলেননি। তিনি বিশ্ববিদ্যায়ের বিভিন্ন সুবিধা অসুবিধা নিয়ে কথা বলেছেন। এতে আন্দোলনকারীরা আরও ক্ষুব্ধ হন নুরের প্রতি। গত শনিবার বর্জনকারীদের প্যানেলে এ নিয়ে অন্যরা তীব্র সমালোচনা করেন।

তবে গতকাল রবিবার প্রগতিশীল ছাত্র

ঐক্য নুরকে ছাড়াই আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করার তিন ঘণ্টা পর সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। এরপর আবার বিকেলে বর্জনকারী ৫ প্যানেল বৈঠক করে আজকের কর্মসূচি ঘোষণা করে।

উল্লেখ্য, গত শনিবার সন্ধ্যায় পুনঃতফসিলসহ চার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দেওয়া আলটিমেটাম শেষ হয়। গত বুধবার নুরুল হক নুর রাজু ভাস্কর্যে ওই কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং দাবি না মানলে বিশ^বিদ্যালয় অচল করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন। কিন্তু শনিবার গণভবন থেকে ফিরে নুর বর্জনকারীদের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করেননি। কর্মসূচি স্থগিতের জন্য তার সংগঠনের অন্য নেতাদের দিয়ে বার্তা বর্জনকারীদের কাছে। এই পরিস্থিতিতে বর্জনকারীরা শনিবার রাতে টিএসসিতে বৈঠকে বসেন। সেখানে নুরের সংগঠনের প্রতিনিধি হাসান আল মামুন উপস্থিত ছিলেন। ১১ মার্চ নির্বাচন বর্জনকারী পাঁচ প্যানেলের দাবিগুলোর মধ্যে ছিল, জালিয়াতির ডাকসু নির্বাচন বাতিল করা; পুনঃতফসিল ঘোষণা করা; নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত ভিসি, প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ অন্যদের পদত্যাগ করা; মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা এবং হামলাকারী সন্ত্রাসীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা।

গতকাল রবিবার দুপুর দেড়টায় আন্দোলনের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্য। প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্যের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দী সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘বর্জনকারী একটি প্যানেলের নেতা নুরুল হক নুর শনিবার গণভবনে যে বক্তব্য দিয়েছে সেটা আন্দোলনের স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছি।’ তিনি কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেন, ‘কাল (সোমবার) আমরা ক্লাস পরীক্ষা বর্জনের ডাক দিচ্ছি এবং আমরা বেলা ১১টায় রাজু ভাস্কর্য থেকে ভিসি কার্যালয়ে অবস্থান গ্রহণ করব।’

লিটন নন্দী বলেন, ‘দীর্ঘ ২৮ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে নির্বাচন হয়েছে, সে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে একধরনের কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয়েছে। আমরা ১১ মার্চ নির্বাচনের দিন ৫টি প্যানেল যৌথভাবে এই নির্বাচনকে বর্জন করেছিলাম এবং একই সঙ্গে নির্বাচনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করে পুনঃতফসিলের দাবি জানিয়েছিলাম।

ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্যের প্যানেল ছাড়া বাকি প্যানেলগুলোকে দেখা যায়নি। এ ব্যাপারে লিটন নন্দী বলেন, আমরা সংবাদ সম্মেলন করছি প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্যের জায়গা থেকে। বাকি তিনটি প্যানেল এখনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। পরে তারা আপনাদের সঙ্গে কথা বলবে। আর নুরের প্যানেলও মনে করে নুর যে বক্তব্য দিয়েছে, সেটা তাদের সংগঠন বক্তব্যের সঙ্গে যায় না। তাই তারাও এখন বসে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তবে তিনি নৈতিকতার জায়গা থেকে এই ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার সুযোগ দেখেন না বলে জানান। নুরের প্যানেল ছাড়া বাকি প্যানেলগুলো থেকে তারা আলাদা হয়ে গেছেন কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা সরে যাইনি। নুর তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার সঙ্গে আমরা এখনো কথা বলতে পারিনি। তবে তার এই বক্তব্য ছাত্রদের স্পিরিটের সঙ্গে প্রতারণাপূর্ণ। আমরা আহ্বান করব, নুর তার বক্তব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সামনে স্পষ্ট করবেন। তবে আমরা সবাইকে নিয়ে আন্দোলনটা করতে চাই এবং ছাত্রদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাই।

প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্যের সংবাদ সম্মেলনের পর বিকেল ৫টায় ডাকসুর নবনির্বাচিত ভিপি নুর মধুর ক্যান্টিনে তার প্যানেলের সদস্যদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আবার আন্দোলনে ফিরে আসার কথা জানান। দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়ে ডাকসুর ভিপি নুর বলেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীরা চাইলে আমি দায়িত্ব গ্রহণ করব। না চাইলে করব না।’ তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি। আমার সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেই গণভবনে গিয়েছি।’

গণভবনে পুনর্নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা কেন বলেননি এর জবাবে নুর বলেন, ‘শনিবার গণভবনে শুধুমাত্র ডাকসুর প্রতিনিধিদের যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গিয়ে দেখি এর বাইরে ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিটের কর্মী সেখানে গিয়েছে। আমি তাদের দেখে অস্বস্তিতে পড়েছি। তাই অনেক কথা বলতে পারিনি।’

এ সময় লিখিত বক্তব্যে নুরের সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক খান বলেন, ‘১১ মার্চ যে ডাকসু নির্বাচন হয়েছে বিভিন্ন কারচুপির কারণে সেটা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন হয়নি। বরং নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। আমরা এই নির্বাচন বাতিল করে পুনর্নির্বাচনের দাবি করছি।’

নুরের সংগঠনের ১০ মিনিট পর আবার বর্জনকারী ৫ প্যানেল যৌথভাবে সংবাদ সম্মেলন করে। এদিকে পাঁচ দফা দাবিতে আজ সোমবার ক্লাস বর্জন ও উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবে নির্বাচন বর্জনকারী পাঁচটি প্যানেল।

সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এই সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা দেন স্বতন্ত্র জোটের ভিপি প্রার্থী অরণি সেমন্তি খান। তিনি বলেন, ‘এই নির্বাচনে অনেক অনিয়ম হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আমরা লিখিতভাবেও জানিয়েছি। আমরা তিন দিনের আলটিমেটাম দিয়েছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তাই আমরা আন্দোলনে নামছি।’ এ সময় পাঁচটি প্যানেলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

ডাকসুর অভিষেকের প্রস্তুতি

আজ সন্ধ্যায় প্রভোস্ট কমিটির সভায় অভিষেক অনুষ্ঠান কবে এবং কীভাবে হবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানী বিষয়টি নিশ্চিত করেন। প্রসঙ্গত, দীর্ঘ ২৮ বছর ১০ মাস বন্ধ থাকার পর গত ১১ মার্চ ডাকসু ও হল সংসদগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের দিন হলগুলোর ভোটকেন্দ্রে নানা ধরনের অনিয়মের অভিযোগ এনে নির্বাচন বর্জন করে ছাত্রলীগ ছাড়া বাকি প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। পুনর্নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে নির্বাচন বর্জনকারী প্যানেলগুলো।