বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত!

রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ারের অষ্টম তলায় (লিফটের সাত) বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। তারপর সেখান থেকেই আগুন ছড়িয়েছে। গতকাল রবিবার ভবনের অগ্নিকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা শুনে এমন কথা জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং ফায়ার সার্ভিসের তদন্তকারী দলের কর্মকর্তারা।
গতকাল সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এফ আর টাওয়ারের পাশে সপুরা টাওয়ারের নিচে পৃথক তিন তদন্ত কমিটির কাছে প্রত্যক্ষদর্শীরা ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দেন। পাশাপাশি ভবিষ্যতে কেউ যাতে এ ধরনের পরিস্থিতির মুখে না পড়েন, সে বিষয়ে পরামর্শও দিয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য ও পরামর্শ শেষ হওয়ার পর ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ফায়জুর রহমান বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দুটি তদন্ত কমিটি যৌথভাবে কাজ করছি। ২৮ মার্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর চতুর্থ দিনে অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানের জন্য ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বক্তব্য শুনেছি। ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরিদর্শনের পর তাৎক্ষণিকভাবে সে বিষয়েও আপনাদের মিডিয়ার সামনে তুলে ধরেছি।’
তিনি বলেন, ‘দুই তদন্ত কমিটির ছয় সদস্য একসঙ্গে বসে ২৪ জনের বক্তব্য নিয়েছি। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, অষ্টম তলায় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে। তবে আমরা এখনই এই সিদ্ধান্তে যাচ্ছি না। গতকাল জমির মালিকের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের কাগজপত্র নিয়েছি। রূপায়ণের বক্তব্য শুনেছি। তাদের কাগজপত্র চেয়েছি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যারা কথা বলতে পারেন, তাদের বক্তব্য নিয়েছি। আগামী ৩ এপ্রিলের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। আমরা সেই সময়ের মধ্যেই দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে ফায়জুর রহমান বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের সময় পুরো ভবন কাচে ঢাকা ছিল, যার কারণে সিঁড়ি ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ছিল। এ কারণেই বেশি মানুষ মারা গেছেন।’
একই কথা বলেছেন ১১ তলার প্রত্যক্ষদর্শী আমিনুল ইসলাম। তিনি তদন্ত দলের সামনে বলেন, ‘১১ তলায় ইইউআর সার্ভিস বিডি লিমিটেডের প্রায় ৪০ জনের মতো ছিলাম। এর মধ্যে আমরা অনেকেই সিঁড়ি ব্যবহার করে ছাদে উঠে পাশে আহমেদ টাওয়ার দিয়ে বের হয়ে গেছি। এরপর নিচে নেমে সবাইকে মেসেজ দিয়ে সেই পথে বের হওয়ার কথা বলেছি। অনেকেই বের হয়েছেন। কিন্তু ধোঁয়া ও অন্ধকারের কারণে অনেকেই সিঁড়ি খুঁজে পাননি, উঠতে কিংবা নামতেও পারেননি, যার কারণে আমাদের একজন নারী সহকর্মীসহ পাঁচজন মারা গেছেন।’
ফায়জুর রহমান বলেন, ‘ভবনে ফায়ার সেফটির জন্য যে ধরনের নিরাপত্তা আগুনের সূত্র আট তলা থাকার কথা, বিশেষ করে অগ্নিকাণ্ডের সময় ভবনে কোনো ফায়ার অ্যালার্ম বাজেনি। এক্সিট ডোর সরু ছিল। কোনো কোনো তলায় বন্ধ ছিল, যার কারণে তারা বের হতে পারেননি। অষ্টম তলার মালিককে ডেকেছি। এ ছাড়া পরিদর্শনের সময় ৮, ৯ ও ১০ তলায় বেশিরভাগ পুড়ে যাওয়া ডেস্কের আলামত পেয়েছি। কোনো তলাতেই হোস পাইপ ব্যবহার করা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘শুনানি গ্রহণকালে আট তলার কাউকে পাইনি। ৯ তলার দুজনকে পেয়েছি। এ ছাড়া একজন সিকিউরিটি গার্ড বলেছেন, তিনি আট তলার ফ্লোর থেকে আগুন বের হওয়ার দৃশ্য দেখেছেন। এরপর সেই তলা থেকে গ্লাস ভেঙে নিচে পড়েছে বলেও জানিয়েছেন।’
ফায়জুর রহমান আরও বলেন, ‘আগুনের সময় ভবনের ভেতরে কী ধরনের সমস্যায় পড়েছিলেন তারা, কী ধরনের সুযোগ থাকলে মারা যাওয়া ব্যক্তিরাও বের হতে পারতেনÑ সেই বিষয়েও তাদের পরামর্শ নেওয়ার জন্য এই শুনানির আয়োজন করা হয়েছিল।’
শুনানি শেষ হওয়ার পর ঘটনাস্থলে হাজির হয়েছিলেন অষ্টম তলার স্পেকট্রা এসএন টেক্স লিমিটেডের অ্যাসিস্ট্যান্ট (কমার্শিয়াল) মিলন উদ্দিন বাধন ও সহকারী ম্যানেজার কফিল উদ্দিন। মিলন উদ্দিন বাধন দেশ রূপান্তরকে জানান, আগুন তাদের অষ্টম তলার ফ্লোর থেকে লাগেনি। তিনি ও কফিল দুজনই অষ্টম তলার সিঁড়িতে ধোঁয়া দেখে সেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাইরে চলে যান।
কফিল উদ্দিন বলেন, সকাল ১০টা থেকে তারা স্যাম্পল নিয়ে কাজ করছিলেন। আগুনের সময় তারা দুজন ছাড়া আর কেউ সেখানে ছিলেন না। তাদের মালিকের নাম সেলিম উল্লাহ, তিনিও ছিলেন না।
ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক নিয়াজ আহমেদ জানান, তাদের তদন্ত কমিটি ১২ জন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্যগ্রহণ করেছে। তাদের বেশিরভাগ বলেছেন, আগুনের সূত্রপাত অষ্টম তলা থেকে হয়েছে। তবে কী কারণে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে, সে বিষয়ে আরও তদন্ত করা হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, গণশুনানির মূল উদ্দেশ্য আগুনের কারণ সম্পর্কে জানা। ভেতরে কী ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিলেন লোকজন, সেই বিষয়ে জেনে ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য সুপারিশমালা পেশ করা। ফায়জুর রহমান বলেন, আগামী ৩ এপ্রিলের মধ্যে তারা তাদের প্রতিবেদন জমা দেবেন।
২৮ মার্চ এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরপর ২৯ মার্চ থেকে বিভিন্ন তদন্ত কমিটি তাদের তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে। তদন্তের অংশ হিসেবেই গণশুনানি করা হয়।
এ বিষয়ে ফায়জুর রহমান বলেন, ‘আমরা জমির মালিকের বক্তব্য শুনেছি। তিনি প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও জমা দিয়েছেন। পাশাপাশি এই ভবন নির্মাণের কাজে যারা ছিলেন তাদেরও কাগজপত্র জমা দেওয়ার জন্য বলেছি।’
ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির পাশাপাশি একই প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য গ্রহণ করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. তরুণ কান্তি শিকদার। এই তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মাসুদুর রহমান। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগুনের কারণ অনুসন্ধানের জন্যই বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিদের বক্তব্য গ্রহণ করা হয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। আশা করছি আগামী ৩ এপ্রিলের মধ্যে আমাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।’