ঢাকা মঙ্গলবার, ৬ই মে ২০২৫, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩২


খালেদা মুক্তির রফা শিগগির


১৭ এপ্রিল ২০১৯ ২০:৪২

আপডেট:
৬ মে ২০২৫ ১০:৪০

দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তি নিয়ে সরকারের সঙ্গে দলটির দর-কষাকষির মধ্যেই বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, আইনি প্রক্রিয়ায় ছাড়া পেলে তাদের নেত্রী চিকিৎসা নিতে যুক্তরাজ্য যাবেন।

তবে সরকারের কথিত চাওয়ামতে রাজনীতি থেকে নির্বাসনে যাবেন না তিনি। তারা আরও বলছেন, খালেদা জিয়াকে হয়রানি না করে বিদেশ যেতে দিলে এমনকি শপথ নেওয়ার কথাও ভাবতে পারেন তারা।

এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, যেকোনো প্রক্রিয়ায় খালেদা বিদেশ চলে গেলে তাদের রাজনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন মসৃণ হয়ে যাবে। এই প্রেক্ষাপটে দুপক্ষের নেতাদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ নেওয়ার দিনক্ষণ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই খালেদার জামিন কিংবা প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি দফারফা হয়ে যেতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা গতকাল মঙ্গলবার বলেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কোনো শর্তে নয়, জামিনেই মুক্তি চান। আর জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি চিকিৎসা নিতে যেতে চান লন্ডনে। তারা বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চায়, অসুস্থ কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাক। সরকারের এমন প্রস্তাব নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের একটি প্রতিনিধিদল খালেদা জিয়ার সঙ্গে গত রবিবার পহেলা বৈশাখে সাক্ষাৎ করেন। খালেদা জিয়া সরকারের এমন প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, তার জামিন প্রাপ্য। জামিনে মুক্ত হতে চান তিনি। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন তার চিকিৎসা দেশে করাবেন, না বিদেশে করাবেন। তবে চেয়ারপারসন সাধারণত লন্ডনে চিকিৎসা করান।

দলের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতার এমন বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির মুখপাত্র মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের প্রস্তাব নিয়ে তারা যাননি। তারা পহেলা বৈশাখ বিশেষ দিনে স্বাভাবিকভাবে বন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয় আছে তার অংশ হিসেবে তারা সাক্ষাৎ করেছেন। তারা অসুস্থ খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন। অন্য কোনো বিষয় নিয়ে নয়।

গত রবিবার পহেলা বৈশাখের বিকেলে শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে খালেদা জিয়াকে দেখতে যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও নজরুল ইসলাম খান। এর আগে কয়েক দফা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন মির্জা ফখরুল। তবে খালেদা জিয়ার স্বজনরা সাক্ষাতের অনুমতি চেয়ে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেও সাক্ষাৎ পাননি।

বিএনপির ওই নেতারা অভিযোগ করে বলেন, খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তি পাওয়ার বিষয়টি কৌশলে আটকে রেখেছে সরকার। তবে তাদের কোনো কৌশলে কাজ হবে না। সরকার খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত জামিনে সহযোগিতা করলেই শুধু বিএনপির সংসদ সদস্যরা সংসদে যোগ দেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবেন। সরকার যত তাড়াতাড়ি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে, বিএনপি তত তাড়াতাড়ি সংসদে যোগ দেবে। কারণ সরকারের যেমন কিছু চাওয়ার আছে বিএনপিরও তেমন কিছু চাওয়ার আছে।

নজরুল ইসলাম খান জানান, পহেলা বৈশাখে তারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রাতেই গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে চেয়ারপারসনের সর্বশেষ অবস্থান অন্য সদস্যদের জানানো হয়। পরদিন গত সোমবার রাতে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

দলের সংসদ সদস্যদের গুলশান কার্যালয়ে ডেকে পাঠান। হুট করে কেউ যেন শপথ না নেন সে বিষয়ে দলের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়।

খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নেতারা বলেন, চেয়ারপারসনের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এটাই এখন মূল সমস্যা। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তার ডায়াবেটিস বা রক্তের শর্করার পরিমাণ ১৬-এর বেশি ছিল। গত কয়েক দিনে এই মাত্রা ১৪-এর ওপরেই ছিল। ডাক্তাররা তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছেন। এছাড়া খাবারের অরুচি ও ঘুমের সমস্যা রয়েছে। আর্থ্রাইটিস সমস্যা দীর্ঘদিনের হওয়ায় খালেদা জিয়ার হাত এবং পায়ের জোড়াগুলোতে ব্যথা রয়েছে। সেজন্য তাকে নিয়মিত থেরাপি দেওয়া হচ্ছে। বয়সের কারণেও সমস্যাগুলোর দ্রুত উন্নতি হচ্ছে না বলে চিকিৎসকরা তাদের জানিয়েছেন।

৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ছয়টি আসনে জয় পায়। তবে কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে নতুন নির্বাচনের দাবি জানায় বিএনপি ও তাদের জোটসঙ্গীরা। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল এ দাবি নাকচ করে বিএনপির নির্বাচিতদের শপথ নিয়ে সংসদে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে। তাদের শপথ গ্রহণের নির্ধারিত সময় শেষ হবে ৩০ এপ্রিল। এরপর শপথ নিতে চাইলে সময় ও যথাযথ কারণ উল্লেখ করে চিঠি দিতে হবে স্পিকারকে। স্পিকার সম্মতি দিলেই তারা শপথ নিতে পারবেন। আর স্পিকারের দেওয়া নির্ধারিত সময়েও শপথ না নিলে আসনগুলো শূন্য ঘোষণা করে নির্বাচন দিতে হবে কমিশনকে।

আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপির সংসদ সদস্যরা শপথ গ্রহণে রাজি হলে কারাবন্দি খালেদা জিয়ার জামিন জটিলতা দূর হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। গতকাল এ ইঙ্গিত দিয়ে তারা জানান, বিএনপির বিজয়ীদের শপথ ও খালেদা জিয়ার বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলেই খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারে জটিলতা কাটতে পারে। আবার খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্ত হয়ে বিদেশ যাওয়ার বিষয় নিয়েও আলোচনা চলছে।

আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লীর দুই সদস্য বলেন, খালেদার জামিনে মুক্তির বিনিময়েও যদি বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ নেন তা হবে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিজয়। এর মধ্য দিয়ে সংসদে সব দলের প্রতিনিধিত্ব যেমন নিশ্চিত হবে তেমনি নির্বাচন নিয়ে যেসব বিতর্ক রয়েছে সেগুলো অনেকাংশে কমে যাবে। অন্তত বিএনপি ফলাও করে নির্বাচনের সমালোচনা নৈতিকভাবে আর করতে পারবে না। করলেও জনগণ তা গ্রহণ করবে না। পাশাপাশি একাদশ সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার দেশ-বিদেশে আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। তাই যেকোনো প্রক্রিয়ায়ই হোক খালেদাকে মুক্তি দিয়ে হলেও বিএনপিকে সংসদে ফেরাতে চান আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর এক সদস্য বলেন, বিএনপিকে সংসদে ফেরাতে খালেদা জিয়াকে ‘দাবার ঘুঁটি’ বলেই মনে করে ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা। তাদের সংসদে যোগদান আওয়ামী লীগের ও সরকারের জন্য বিশেষ সুফল নিয়ে আসবে।

আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন নেতা মনে করেন, ২৪ এপ্রিল সংসদ অধিবেশন বসবে। তার আগেই খালেদার মুক্তি ও বিএনপির নির্বাচিত সদস্যদের শপথের ব্যাপারটি আরও স্পষ্ট হয়ে যাবে। তারা বলেন, বিএনপির নেতারা চান খালেদা জিয়ার মুক্তি। আমরা চাই বিএনপির নির্বাচিত সদস্যরা সংসদে আসুক। দুয়ে দুয়ে চার হয়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। বিষয়টি অনেকদূর এগিয়েছেও।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের ধারণা, খালেদা জিয়া জামিনে মুক্ত হয়ে বিদেশ চলে যাবেন। বিদেশ গিয়েও তার বক্তব্য-বিবৃতিতেও কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করতে চায় সরকার।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর আরেক সদস্য বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি ইস্যুতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য ইঙ্গিতপূর্ণ। তিনি বলেন, আলোচনা অনেকদূর এগিয়েছে বলেই খালেদার মুক্তি নিয়ে মুখ খুলেছেন তিনি। ২৪ এপ্রিলের মধ্যে এই প্রক্রিয়া আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে।