ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ৮ই মে ২০২৫, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩২


৪০০ ব্যাংক হিসাব জব্দ

তালিকাভুক্ত দুর্নীতিবাজ ৮০০ ছাড়িয়েছে


৩১ অক্টোবর ২০১৯ ১৬:৩৮

আপডেট:
৮ মে ২০২৫ ১৬:১২

ক্যাসিনো ও অবৈধভাবে ক্লাব পরিচালনা, চাঁদাবাজি, টাকা পাচার, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িতদের তালিকা আট শতাধিক ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে মন্ত্রী, এমপি, ব্যাংকার, সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক প্রভাবশালী নেতা, ঠিকাদার, পুলিশ ও বিভিন্ন পর্যায়ের পাঁচ শতাধিক ব্যক্তির দুর্নীতির অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তারা বলছে, ইতিমধ্যে হাইপ্রোফাইল বলে খ্যাত শতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে।

এদিকে গতকাল বুধবার চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে জব্দ করা ৪০০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের হিসাব চেয়ে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে চিঠি পাঠিয়েছে দুদক। এর আগে গত সোমবার ৭১ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে বলে দুদক ও বিএফআইইউর কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন।

গতকাল দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) সাঈদ মাহবুব খানের সই করা চিঠিতে বলা হয়েছে, চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশনে বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জন সংক্রান্ত অনুসন্ধান/মামলা চলমান রয়েছে।

‘বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যসূত্রে জানা যায়, বিএফআইইউ চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত চার শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে। দুদক চলমান অনুসন্ধান ও মামলাসমূহের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য জব্দ করা হিসাবসমূহের বিবরণীসহ প্রকৃত অর্থ লেনদেনসংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করা আবশ্যক।’

চিঠিতে আরও বলা হয়, সুষ্ঠু অনুসন্ধান ও তদন্তের স্বার্থে এখন পর্যন্ত জব্দ করা চার শতাধিক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের হিসাব বিবরণী ও প্রকৃত আর্থিক লেনদেনের তথ্য/রেকর্ডপত্র জরুরি ভিত্তিতে পাঠিয়ে অনুসন্ধান ও তদন্তকাজে সহযোগিতা করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়েছে। দুদকের একাধিক কর্মকর্তা ও বিএফআইইউর এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ৪০০ ব্যাংক হিসাব জব্দের তালিকায় অনেক হাইপ্রোফাইল ব্যক্তি রয়েছেন। যাদের মালয়েশিয়া এবং বিভিন্ন দেশে বাড়ি রয়েছে। দেশের বাইরে তাদের সম্পদ রয়েছে। অনুসন্ধান সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তাদের নাম প্রকাশ করা যাবে না।

দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সার্বক্ষণিক বিষয়টি মনিটর করা হচ্ছে। সতর্কতার সঙ্গে অনুসন্ধান চলছে। ক্যাসিনোকাণ্ডে যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, জি কে শামীম, সেলিম প্রধানসহ গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা অনেক প্রভাবশালীর সম্পদের তথ্য দিয়েছেন। তারা কীভাবে টাকা পৌঁছে দিতেন এবং হুন্ডির মাধ্যমে কীভাবে টাকা পাচার হতো এসব তথ্য দিয়েছেন। বিএফআইইউ কাজ করছে। বর্তমান ও সাবেক মন্ত্রী, এমপি, মেয়র, পুলিশ, আমলা, ব্যবসায়ীসহ প্রভাবশালীর ব্যাংক হিসাব অনুসন্ধান করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ রয়েছে কাউকে যেন ফেভার না করা হয়।

দুদক ও বিএফআইইউ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন, চট্টগ্রাম-১২ আসনের এমপি ও জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, যুবলীগের অব্যাহতি পাওয়া চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, স্বেচ্ছাসেবক লীগের অব্যাহতি পাওয়া সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওছার ও সাধারণ সম্পাদক পংকজ দেবনাথ, যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণ মহানগর শাখার বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বহিষ্কৃত কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক ও বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ, ঢাকা দক্ষিণ সিটির কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুবলীগ বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি ও কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা শফিকুল আলম ফিরোজ, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বহিষ্কৃত দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিছুর রহমান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান বকুল, গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু ও সহ-সম্পাদক রুপন ভূঁইয়া, যুবলীগ নেতা ও ঠিকাদার জি কে শামীম, গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ও বর্তমান অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল হাইয়ের হিসাব জব্দ করেছে বিএফআইইউ। পাশাপাশি অভিযুক্তদের পরিবারের সদস্যদেরও ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে সংস্থাটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পরিচালিত শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে বিভিন্ন ক্লাবে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসব ক্লাবে অবৈধ ক্যাসিনোর সন্ধান পাওয়া যায়।

দুদকের মহাপরিচালক (বিশেষ তদন্ত) সাঈদ মাহবুব খানকে তদারক কর্মকর্তা ও পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনকে প্রধান করে ছয় সদস্যের অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়। এর অন্য সদস্যরা হলেন– দুদকের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সালাউদ্দিন আহম্মেদ, সহকারী পরিচালক নেয়ামুল আহসান গাজী ও মামুনুর রশিদ চৌধুরী।

দুদকের এক পরিচালক জানান, প্রথম ধাপের তালিকায় আছেন ৫০ জন এবং দ্বিতীয়টিতে ২১ প্রভাবশালীর নাম আছে। তারা যাতে সম্পদ স্থানান্তর-হস্তান্তর, পাচার বা বিক্রি করতে না পারেন সেজন্য দুদক এ উদ্যোগ নিয়েছে। সম্পদ ক্রোকের জন্য কমিশনের অনুমতি নিয়ে আদালতে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধের মধ্যে আছে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগ। তালিকাভুক্তদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের অনুসন্ধান করছে সংস্থাটি। এছাড়া অন্যান্য সংস্থাও অনুসন্ধান-তদন্তে একযোগে কাজ করছে। দুদকের এক মহাপরিচালকের তত্ত্বাবধানে ও এক পরিচালকের নেতৃত্বে সাত সদস্যের দল এদের অবৈধ সম্পদ ও মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়ে অনুসন্ধান করছে। ওই কর্মকর্তাদের হাতে অনুসন্ধানের অন্য যেসব কাজ ছিল সেগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছেন, তারা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সামনে এগোচ্ছেন। দুদক কমিশনার ড. মোজাম্মেল হক খান বলেছেন, অন্তত ১০০ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান প্রক্রিয়াধীন।

কাজ শেষে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। এ তালিকা আরও দীর্ঘ হবে জানিয়ে তিনি বলেন, দুদক এখন আর নখদন্তহীন বাঘ নয়। দুদক এখন একটি শক্তিশালী স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। দুদক সূত্রে জানা গেছে, তালিকাভুক্ত প্রভাবশালীদের অবৈধ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক করার জন্য আদালতে আবেদন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে জি কে শামীম ও তার স্ত্রী, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, গেণ্ডারিয়ার এনামুল হক এনু, রুপন ভূঁইয়া, পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (কারা) বজলুর রশিদের অবৈধ সম্পদ ক্রোকের অনুমতি চেয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তারা কমিশনের কাছে আবেদন করেছেন।

কমিশনের অনুমোদনসাপেক্ষে আজকালের মধ্যে আদালতে আবেদন করা হবে। জানা গেছে, প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে জি কে শামীম ও খালেদসহ ছয়জনের কাছে ৩৪০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুদক। এর মধ্যে শামীম ও তার স্ত্রীর নামে ২৯৭ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের সন্ধান পেয়েছে দুদক। এছাড়া খালেদের ৫ কোটি টাকার এবং এনু ও তার ভাই রুপনের ৩৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ আছে। একইভাবে বজলুর রশিদের ৩ কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পেয়েছেন কমিশনের কর্মকর্তারা। এদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। দুয়েক দিনের মধ্যে আরও পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। তাদের কাছেও বিপুল অঙ্কের অবৈধ সম্পদ আছে– এমন তথ্য পেয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।

দুদক সচিব মোহাম্মদ দিলওয়ার বখত বলেন, মামলা হওয়ার পর এমনকি অনুসন্ধানকালেও প্রয়োজনে তদন্ত কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সম্পদ ক্রোকের আবেদন করতে পারেন। দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত অনুসন্ধান দল এরই মধ্যে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজের একটি তালিকা প্রণয়নের কাজ করছে। দুদকের আরেক পরিচালক কাজী শফিকুল আলমকেও এ অনুসন্ধান কাজে নিয়োজিত করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, দুদক কর্মকর্তারা অফিস সময়ের বাইরেও অনুসন্ধান কাজে মাঠপর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করছেন। বিএফআইউউ, এনবিআরের গোয়েন্দা সেল (সিআইসি), র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগ, সিআইডি ও অন্যান্য সংস্থা থেকে দুর্নীতির তথ্য ও নামের তালিকা সংগ্রহ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। সবাই একযোগে কাজ করায় অভিযুক্তদের তালিকায় প্রতিদিনই নতুন নাম যুক্ত হচ্ছে।