ঢাকা রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


কর্মী ঠকিয়ে মুনাফা বিমানের


২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২০:৫৬

আপডেট:
১৯ মে ২০২৪ ০৩:২৪

করোনাভাইরাস মহামারীতে সরকারের কোনো দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কমেনি। বরং পদোন্নতি হয়েছে আগের বছরের তুলনায় বেশি। একমাত্র বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসেই এর ব্যতিক্রম। ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়ার অজুহাত দেখিয়ে কর্মীদের বেতন-ভাতা কাটা হয়েছে। পাইলট থেকে শুরু করে লোডার পর্যন্ত এ খড়গের শিকার হয়েছেন।

বাধা-প্রতিবাদের মুখে বছর পার করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাটি ১৫৮ কোটি টাকা অপারেটিং মুনাফার ঘোষণা দেওয়ায় বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছে।

গত ১২ ডিসেম্বর বিমানের বার্ষিক সাধারণ সভা হয়েছে। সেখানে বিমান পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান সাজ্জাদুল হাসান সংস্থাটির গত অর্থবছরের (২০২০-২১) মুনাফার ঘোষণা দিয়েছেন। বৈশি^ক মহামারীর মধ্যে তারা কীভাবে মুনাফা করেছেন তার ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন।

সাজ্জাদুল হাসান বলেছেন, নন-শিডিউল ফ্লাইট এবং জাতিসংঘের মিশন ফ্লাইট পরিচালনা করে তারা মুনাফা করেছেন। চারটি নিউ জেনারেশন এয়ারক্রাফটের বহরে অন্তর্ভুক্তি এবং শর্ট টার্মের লিজ এয়ারক্রাফটের ব্যবহার বিমানকে মুনাফা করতে সহায়তা করেছে। এজন্য পর্ষদ চেয়ারম্যান বিমানের ব্যবস্থাপনাকে অত্যন্ত দক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

২০২০ সালের ৫ মে প্রশাসনিক আদেশে বিমানের পাইলট, কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন কমানো হয়। সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ১০ থেকে ২৫ শতাংশ এবং পাইলটদের ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ বেতন কাটা হয়। একই সঙ্গে স্থায়ী প্রকৃতির ভাতা-ফুড সাবসিডি, মিল অ্যালাউন্স স্থগিত করা হয়। এ ছাড়া পাইলটদের ওভারটাইম, প্রোডাক্টিভিটি অ্যালাউন্স, ফ্লাইং অ্যালাউন্সও দেওয়া হয়নি। এভাবে বিমান গত অর্থবছরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৮৮ কোটি টাকা কাটা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তে পাইলটসহ বিমানের কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ-অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।

গত ১৩ জুলাই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের জারি করা এক আদেশে বলা হয়, বিমানের বেতনক্রম ৬ থেকে তদূর্ধ্ব তথা সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন কাটার হার কমিয়ে শূন্য করা হয়েছে। আর যেসব পাইলট ৫ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত চাকরি করছেন, তাদের বেতন কাটার হার ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে।

আদেশে আরও বলা হয়, যারা ১০ বছরের বেশি সময় কাজ করছেন, তাদের বেতন কাটার হার ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। ওই সিদ্ধান্তের পরে পাইলটরা গত ৩০ জুলাই থেকে আন্দোলনে যাওয়ার ডাক দিয়েছিলেন।

ঘোষণা দিয়েও বেতন-ভাতা সমন্বয়ে দেরি হওয়ায় গত অক্টোবর মাসে বিমানের পাইলটরা কর্মঘণ্টার অতিরিক্ত কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেন। বিমানের ১৫৭ পাইলটের মাসে নির্ধারিত কর্মঘণ্টা অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে ৬০ ঘণ্টা ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে ৭৫ ঘণ্টা। ক্ষুব্ধ পাইলটদের কারণে ওই মাসে বিমানের দুটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ছাড়তে দেরি হয়।

বেতন-ভাতা কেটে নেওয়ার জন্য অনেক কর্মচারীকে মহামারীর মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়েছে। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসা করাতে পারেননি অনেক কর্মচারী।

বিমান গত অর্থবছর ৮৬টি নন-শিডিউল চার্টার্ড ফ্লাইট পরিচালনা করেছে। এর মধ্যে ৩৪টি মিশন ফ্লাইট রয়েছে। এসব ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে সংস্থাটি ১৮২ কোটি টাকা আয় করেছে। বাংলাদেশিরা যখন বিদেশে আটকা পড়ে তখন বিমান সেখানে ফ্লাইট পরিচালনা করে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনে। মহামারীতেও চীনে আটকা পড়াদের দেশি ফিরিয়ে এনেছে। বৈরুত, ইতালি, লন্ডনে ফ্লাইট পরিচালনা করে প্রবাসীদের দেশে ফিরিয়ে এনেছে। অনেক নন-শিডিউল ফ্লাইট পরিচালনা করে মহামারী নিয়ন্ত্রণের জন্য ভ্যাকসিন, সিরিঞ্জসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য উপকরণ দেশে এনেছে।

বিমানের জনবল রেশনালাইজ করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। মহামারীর সময়েও বিমানে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রায় ৯০০ বিমানকর্মীর নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। যদিও বিমান পরিচালনা পর্ষদ অনুমোদিত সাংগঠনিক কাঠামোতে পদ ৫ হাজার ৪৫৮ জন হলেও বর্তমান বিমানে জনবল রয়েছে ১০ হাজারেরও বেশি। বিভিন্ন পরিদপ্তরে সম্প্রতি যারা অবসরগ্রহণ করেছে তাদেরও পুনরায় নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। সরকার বাংলাদেশ বিমান করপোরেশনকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরের সময় বিমানের জনবল ৩ হাজার ৪০০ রাখা এবং অর্থ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বিমানের শতভাগ মালিকানা সরকারের হওয়ায় এ ধরনের শর্ত আরোপ করে সরকার। কিন্তু এসব শর্ত অনুসরণ করা হয়নি বোর্ডের দোহাই দিয়ে।

করোনা মহামারীতে বিশে্ব যেসব খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মধ্যে বিমান চলাচল (এভিয়েশন) অন্যতম। ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইএটিএ) তথ্য অনুযায়ী বিশে^ ৩২টি এয়ারলাইনস দেউলিয়া হওয়ার জন্য মামলা করেছে, ৮৫টি এয়ারলাইনস কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। কভিডের ধ্বংসাবশেষ থেকে এভিয়েশন ব্যবসা আবার শুরু হয়েছে এবং টিকে থাকার লড়াই করছে। এই অবস্থায়ও বিমানের জন্য কোনো সমন্বিত নীতি নেই। উল্টো বিমান ইজারায় নেওয়া উড়োজাহাজ (এয়ারক্রাফট) কিনছে। ২০ বছরের পুরনো এসব উড়োজাহাজ দিয়ে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারবে না বিমান। দেশের ভেতরে চালাতে সমস্যা না থাকলেও বিদেশে রয়েছে।

গত অর্থবছরে বিমান নেট অপারেটিং মুনাফ করেছে ১৫৮ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ২৯৫ শতাংশ বেশি। গত বছর ৯ লাখ ৮৭ হাজার যাত্রী বহন করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৫২ শতাংশ কম। কার্গো বহন বেড়েছে ২৪ শতাংশ। ২০১৯-২০২০ সালে কার্গো বহন হয়েছে ২২ হাজার ৬৫১ টন। গত বছর কার্গো বহন হয়েছে ২৮ হাজার ১৫৯ টন।

যাত্রীবাহী উড়োজাহাজে মালামাল (কার্গো) বহন করে বিমানের মুনাফা বেড়েছে কিন্তু ক্ষতিও হয়েছে। গত বছর কার্গো বহন করে আয় হয়েছে ২ কোটি ১ লাখ টাকা। তার আগের বছর সেটা ছিল ১ কোটি ৪৮ লাখ। ৩৬ শতাংশ আয় বেড়েছে। মাত্র ৫৩ লাখ টাকা আয় করতে গিয়ে বিমানের ক্ষতি হয়েছে শত কোটি টাকার বেশি। গত অর্থবছরে ২৮ হাজার ১৫৯ টন কার্গো বহন করেছে। যা আগের বছরের চেয়ে ২৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। ২০১৯-২০ সালে কার্গো বহন করেছে ২২ হাজার ৬৫১ টন।

কার্গো বহন করতে গিয়ে বিমানের কী ক্ষতি হয়েছে জানতে চাইলে একজন কর্মকর্তা জানান, যাত্রী কেবিনে ভারী কার্গো বহন করায় মূলত উড়োজাহাজগুলোর ভেতরে খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে ৪টি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআরের বেশি ক্ষতি হয়েছে। অনেক আসনের হাতল দুমড়েমুচড়ে গেছে। পুরোপুরি এবং আংশিক ভেঙে গেছে অনেক আসন। বিকল হয়ে গেছে মুভি সেট। এ ছাড়া নষ্ট হয়েছে টয়লেট, ফ্লোর, দেওয়াল, খাবার রাখার গ্যালিসহ গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র।

গত বছর অতিরিক্ত ব্যাগ পরিবহন করে বিমানের আয় বেড়েছে ৮ লাখ টাকা। আগের বছরের ৫০ লাখ টাকা গত অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮ লাখ টাকায়।

মহামারীর মধ্যেও বিমানের অপারেটিং মুনাফা একটি বড় ঘটনা। এ ছাড়া যাত্রীবাহী উড়োজাহাজে কার্গো বহন করার ক্ষতি, জনবল নিযোগ, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলার জন্য বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আবু সালেহ্ মোস্তফা কামালকে অনুরোধ জানানো হলেও তিনি তাতে সাড়া দেননি।

বিমানের ৫০ বছরপূর্তি উদযাপন আজ : আজ বুধবার ৫০ বছরপূর্তি উদযাপন করবে বিমান। দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। সংস্থার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে কেক কাটা হবে। এ ছাড়া অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের স্মৃতিচারণ, ভোজ, সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা ও র‌্যাফেল ড্র রয়েছে।