ঢাকা শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১


রাতারাতি ব্যক্তিমালিকানায় ৪শ কোটির সরকারি বাড়


২৮ জানুয়ারী ২০২৪ ২২:৫৫

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:৪০

৪৭ বছর ধরে ঝুলে থাকা জটিলতার সমাধান হয়ে গেছে মাত্র পাঁচ মাসেই। গায়েব হয়ে গেছে সংশ্লিষ্ট নথিও। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় নিজেদের ন্যায্য হিস্যা ছেড়ে দ্বিতল ভবনসহ ১ বিঘা ৫ কাঠা ১০ ছটাক আয়তনের একটি বাড়ি ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর করেছে।

ঢাকার গুলশান-২ এর সিইএন (সি) ব্লকের ৯৮নং সড়কের ৬ নম্বর বাড়িটির বর্তমান মূল্য প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। রাষ্ট্রের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি বিবেচনায় না নিয়ে খোদ মন্ত্রণালয়ের এমন ‘উদারতা’ নিয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে হওয়ায় তোলপাড় চলছে বলে জানা গেছে।

নথিপত্র বলছে, দেশের অন্যতম অভিজাত আবাসিক এলাকা গুলশানের আদি নাম ভোলা গ্রাম। ওই এলাকার জমিজমার পুরোনো কাগজে এখনো ভোলা সামাইর মৌজার উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে ১৯৬১ সালের দিকে গ্রামটি অধিগ্রহণ করে সেখানে পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা গড়ে তোলেন ডিআইটির (ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট) প্রথম চেয়ারম্যান পাকিস্তানি আমলা জি এ মাদানি।

ওই সময় করাচির অভিজাত এলাকা গুলশানের নাম অনুসারে ঢাকার সন্নিকটে এই আবাসন প্রকল্পটির নামকরণ করা হয় গুলশান। ওই সময় পূর্ব বাংলায় বসবাস করা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভাবশালীদের জায়গাজমি বরাদ্দ দেন জি এ মাদানি। তারাও ঢাকার পাশে ছায়া সুনিবিড় পরিবেশে থাকতে বেছে নেন গুলশানকে। গুলশান এলাকার জমিজমার পুরোনো কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ৯৮নং সড়কের ৬ নম্বর বাড়ির পুরোনো মালিকের নাম নবাব ওয়াজি উল্লাহ। স্বাধীনতার আগে এখানে একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। পরবর্তী সময়েও এর কোনো পরিবর্তন করা হয়নি।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর বাংলাদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে পাড়ি জমান ওয়াজি উল্লাহ। স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশবলে (পিও-১৬/৭২) বাড়িটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ’৭৩ সালে বাড়িটি গণপূর্তের গেজেটভুক্ত হয়। এরপর ওই বাড়ির এক সময়ের কেয়ারটেকার কেপি আজগার আলী এর মালিকানা দাবি করে হাইকোর্টে রিট (নম্বর ২৫১/১৯৭৩) করেন। ১৯৭৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে এটি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত নয় মর্মে ঘোষণা করা হয়।

সাধারণত এ ধরনের রায়ের বিরুদ্ধে পূর্ত মন্ত্রণালয় আপিল করে থাকে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এই রিটের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। বরং ১৯৮৬ ও ৮৮ সালে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের গেজেটে পরিত্যক্ত তালিকায় এই বাড়িটির নাম ওঠানো হয়নি। শুধু একটি মামলার রায়ের ওপর ভিত্তি করে কোনো সম্পত্তিকে এভাবে পরিত্যক্ত তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার নজির এ দেশে আর নেই বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি। অন্যদিকে, রিটে জয়লাভ করলেও বাড়ির দখল বুঝে নিতে কেপি আজগর আলীকে আদালতে আরেকটি আবেদন করতে হতো। কিন্তু তিনিও সে ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেননি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দখল পাওয়ার জন্য আদালতে গেলে বাড়িটি কোনোভাবেই রাজউকের হাতছাড়া হওয়ার সুযোগ নেই। এ বিষয়টি বুঝতে পেরেই রিটকারী কেপি আজগর আলী আদালতের দ্বারস্থ হননি। ফলে হাইকোর্টের রায় সত্ত্বেও সেই সময় বাড়িটির দখলস্বত্ব অনিষ্পন্ন রয়ে যায়। জানা গেছে, আইনি রাস্তায় না হেঁটে শুরু থেকেই মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালীদের সন্তুষ্ট করে বাড়িটি দখলে নিতে চেয়েছেন আজগর আলী।

৪৭ বছর পর এ প্রক্রিয়ায় সফল হয়েছেন তিনি। সম্প্রতি হঠাৎ করেই বাড়ির দখলস্বত্ব কেপি আজগর আলীকে বুঝিয়ে দেওয়ার তৎপরতা শুরু হয়। মাত্র চার মাসের প্রক্রিয়ায় তার নামে নামজারি করে দেওয়া হয়েছে ওই বাড়ি। রাজউকের স্টেট শাখা সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ২ আগস্ট রাজউকে জমিটির বণ্টননামা রেকর্ড এন্ট্রি হয়—যার ক্রমিক নং ২৯। বণ্টননামা সূত্রে নামজারির চূড়ান্ত পত্র জারি হয় একই বছরের ১৭ অক্টোবর। ৫ নভেম্বর প্রথম হাজিরা চিঠি দেওয়া হয়। আর ২৭ ডিসেম্বর দ্বিতীয় হাজিরা চিঠি জারি করা হয়।

রাজউকের এক সহকারী পরিচালক বলেন, ‘রাজউকের কমবেশি অনেকেই জানেন, উঁচুমহলের তদবিরে মাত্র দুই মাসের মধ্যে বাড়িটি ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর হয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘এ বাড়িটির বিষয়ে পূর্ত মন্ত্রণালয় যেভাবে আমাদের চিঠি দিয়েছে, অতীতে এভাবে এমন করে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো চিঠি দেওয়ার নজির নেই। রাজউকের তালিকায় নাম থাকা না থাকা এক্ষেত্রে মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়।

১৯৭৩ সালে গেজেটভুক্ত হয়েছিল কি না—সেটিই প্রধান বিবেচ্য। পূর্ত মন্ত্রণালয় তাদের হাতে নথি রেখে এ বাড়ির বিষয়ে জানতে চেয়ে রাজউকে কেন চিঠি দেয়, তা বোধগম্য নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আসলে উঁচু মহল থেকে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হওয়ার কারণেই বাড়িটি রাজউক থেকে এরই মধ্যে নামজারি হয়ে গেছে।

এখানে আসলে রাজউকের কোনো কিছুই করার ছিল না। আমরা শুধু আদেশ পালন করেছি মাত্র।’ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এর আগে ২০১০ সালে এ বাড়িটির বিষয়ে পূর্ত সচিবকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন রাজউকের সচিব। সেই চিঠিতে ১৯৭৩ সালে পরিত্যক্ত সম্পত্তির গেজেটভুক্ত হওয়ার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু এবার সেই তথ্য উল্লেখ না করেই পূর্ত মন্ত্রণালয় এ সম্পত্তিটি চূড়ান্তভাবে ব্যক্তি বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দেওয়ার অনুশাসন দেয়। এ-সংক্রান্ত চিঠিটি ইস্যু করেছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপসচিব অভিজিৎ রায়। যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ছোট কর্মচারী। এখানে যা কিছু হয়েছে সবই ওপরের নির্দেশে।

’ ৪৭ বছর পর কেন এই বাড়িটি অনুশাসন প্রদানের জন্য চিঠি দেওয়া হলো—এমন প্রশ্নে জবাবে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারব না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দ্বারা আদিষ্ট হয়ে চিঠি দিয়েছি।’ অন্যদিকে গুলশান আবাসিক এলাকার সিইএন (সি) ব্লকের ৯৮ নম্বর সড়কের ৬ নম্বর প্লটটি ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের গেজেট অনুযায়ী পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত নয় বলে জানান রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ (বাস্তবায়ন) মো. আশরাফুল ইসলাম। এ বিষয়ে এর বেশি কিছুই জানেন না বলে তার দাবি।

গুলশান এলাকার একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে । তারা জানান, এ বাড়িটিকে সবাই নন-বেঙ্গলী বাড়ি হিসেবেই চেনেন। স্থানীয়ভাবে বাড়িটির পরিচয় হোয়াইট হাউস। বিশাল আকৃতির সাদা রঙের এই দ্বিতল বাড়িটিতে যারা থাকেন, তারা সচরাচর কারও সঙ্গে কথা বলেন না। বাসা থেকে গাড়িতে করে বের হয়ে যান। আবার গাড়িতে করে ফিরে এসে বাড়িতে ঢুকে যান। সন্ধ্যার পর বাড়িটি প্রায় অন্ধকার থাকে।

চলতি মাসের ১০ থেকে ২২ তারিখের মধ্যে ১০ বারের বেশি সরেজমিন গিয়েও ওই বাড়ির কারোর সাক্ষাৎ মেলেনি। এমনকি অনুমতি মেলেনি বাড়িতে প্রবেশেরও। বাড়ির প্রধান ফটকে কলিংবেল চাপলে নুরন্নবী নামে এক নিরাপত্তা প্রহরী ফটক খুলে পরিচয় জানতে চান এ প্রতিবেদকের।

এ সময় বাড়ির মালিক কেপি আজগর আলী কোথায় আছে—জানতে চাইলে তিনি বাসায় আছে বলেই জানান ওই প্রহরী। তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে নিরাপত্তা প্রহরী বলেন, ‘স্যার কারও সঙ্গে কথা বলেন না।’ পরে তিনি প্রধান ফটক বন্ধ করে দিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে যান।

এর পরও কয়েকবার কেপি আজগর আলীর সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য গত কয়েকদিন ধরে রাজউকের চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞার সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। অনেকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। পরে রাজউকের কার্যালয়ে গেলে তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা জানান, ‘স্যার ব্যস্ত আছেন। কথা বলা যাবে না।’ গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এ বিষয়ে তার কাছে কোনো তথ্য নেই।