পুলিশের গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়, চাঁদার টাকার ভাগ পায় গুটিকয়েক রাজনৈতিক উপরওয়ালা * পতিতাপল্লীতেও আছে দুটি বাড়ি, নিয়ন্ত্রণ করে তার সশস্ত্র ক্যাডাররা * অন্যের জমি দখল করে হ্যাচারি
পদ্মাপারের ত্রাস নুরু মণ্ডল: দৌলতদিয়া ঘাট থেকেই আয় শত কোটি টাকা

‘নুরু মণ্ডল তার অসংখ্য পাইক-পেয়াদা ও দলীয় অনুসারীদের দিয়ে দৌলতদিয়া ফেরি ঘাটের পরিবহন সেক্টরকে চাঁদাবাজির আখড়া বানিয়ে রেখেছে। পারাপারের উদ্দেশে ঘাটে আসা পরিবহনের চালকরা নিজের হাতে ফেরির টিকিট কাটতে পারেন না। নুরু মণ্ডলের পাইক-পেয়াদারা টিকিট কেটে দেয়। প্রতিদিন এ ঘাট থেকেই ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা অবৈধভাবে আয় করে থাকে।’
পুলিশের গোপন প্রতিবেদনে এমন তথ্য ছাড়াও চাঁদাবাজির যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তাতে বছরে এমন চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় শত কোটি টাকা। এ টাকার ভাগ পায় কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও বিআইডব্লিউটিএর কয়েক কর্মকর্তা। এভাবে নুরু মণ্ডল বাহিনীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সব পরিবহন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইজিপির কাছে পাঠানো পুলিশের গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘দৌলতদিয়া এলাকায় সিন্ডিকেট তৈরি করে ফেরি ঘাট, দৌলতদিয়া পতিতাপল্লী ও ঘাটের আশপাশ এলাকায় মাদক ব্যবসাসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করে থাকে। এছাড়া প্রায়ই নুরু মণ্ডল ফেরিঘাটে অরাজকতা সৃষ্টি করে থাকে। তার রয়েছে বিশাল ক্যাডার বাহিনী। তাদের নেতৃত্ব ও পরিচালনার দায়িত্ব সে পালন করে থাকে।’
এ বিষয়ে আরও বলা হয়, লোভনীয় এ সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তারে মাঝে-মধ্যে খুন ও গুমের ঘটনা ঘটে। জেলা বিশেষ শাখার রেকর্ড পর্যালোচনায় দেখা যায়, ‘২০০৬-০৭ সালের সন্ত্রাসী তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পরে রাজনৈতিক প্রভাব ও ছত্রছায়ার কারণে ২০০৮ সাল থেকে নুরু মণ্ডলের নাম তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। তবে সন্ত্রাসী কার্যক্রম এখনও আছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নুরু মণ্ডল বাহিরচর দৌলতদিয়া গ্রামে জনৈক এক মহিলার বাড়িতে যাতায়াত করত। ওই মহিলাকে ভালো কাজের সন্ধান দেয়ার নাম করে তার শ্লীলতাহানি করে। এরপর নির্যাতিত ওই মহিলা নিজে বাদী হয়ে ২০০৪ সালের ৩০ নভেম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। গোয়ালন্দ ঘাট থানার মামলা নং-২। পরে ওই মামলায়ও তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়। ২০০৭ সালের ১৯ নভেম্বর দৌলতদিয়া পতিতাপল্লীর লিপি নামের এক বাড়িওয়ালিও নুরু মণ্ডলের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করেন। গোয়ালন্দ থানার মামলা নং-৯।
এলাকাবাসীর জিডিতে ভয়াবহ ক্লু : তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, সন্ত্রাসী নুরু মণ্ডলের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালের ২৯ জুন দৌলতদিয়া ও গোয়ালন্দ এলাকাবাসীর পক্ষে একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। তখন তিনি দৌলতদিয়া ইউনিয়নের মেম্বার।
জিডিতে বলা হয়, ‘আমরা দৌলতদিয়া ইউনিয়নবাসী কয়েক বছর ধরে নুরু মণ্ডলের সন্ত্রাসী বাহিনী দ্বারা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত। তার সন্ত্রাসী কার্যকলাপে কেউ বাধা দিলে তাকে মৃত্যুর ভয় দেখায়। হুমকি না শুনলে মানুষ হত্যার মতো জঘন্য কাজ করতে দ্বিধা করে না।’
জিডিতে বলা হয়, ‘মানুষ হত্যার প্রমাণস্বরূপ দৌলতদিয়া ও গোয়ালন্দবাসীর মুখে একটি কথা শোনা যায়, মরহুম শামসু মাস্টারের মতো গুণী লোককে হত্যার নায়ক নুরু মণ্ডল। এ একই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নাজিমুদ্দিনকে মদের সঙ্গে অতিরিক্ত পয়জন মিশিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করার কথাও শোনা যায়।’
নারী নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে বলা হয়, ‘পতিতাপল্লীর মেয়েরদের জোর করে ধর্ষণ করে। সর্দারণীদের ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি করে। পতিতাপল্লীতে আসা সাধারণ মানুষের বুকে অস্ত্র ধরে সর্বস্ব কেড়ে নেয়। এ ধরনের বহু সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সে। গোয়ালন্দ থানা বিএনপি নেতার ছাত্রছায়ায় থেকে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে এ নুরু মণ্ডল।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরে রাজবাড়ি জেলা পুলিশের পাঠানো গোপন প্রতিবেদনে নুরু মণ্ডলের বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে। শুধু পার্থক্য হচ্ছে- নুরু মণ্ডল ওই সময় বিএনপি নেতার ছাত্রছায়ায় ছিল আর এখন আছে স্বয়ং স্থানীয় সংসদ সদস্যের মদদ ও ছত্রছায়ায়।
এছাড়া নাজিমুদ্দিনের মৃত্যু ও শামসু মাস্টারকে হত্যার বিষয়ে তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব অভিযোগ যাচাইয়ের চেষ্টা করা হয়। নাজিমুদ্দিনের ছেলে আবদুল হালিম ফকির যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি তখন ২৫-২৬ বছরের যুবক। জিডির বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আমরা বাবার মৃত্যু মেনে নিয়েছি।’
গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়, দৌলতদিয়া ঘাট থেকে ঢাকাগামী অন্তত সহস্রাধিক পরিবহন যাতায়াত করে। ছোট ট্রাকের ফেরি ভাড়া ১ হাজার ৬০ টাকা। আর বড় ট্রাকের ভাড়া ১ হাজার ৪৬০ টাকা। অথচ নুরু মণ্ডলের ক্যাডার বাহিনী ছোট ট্রাকের ভাড়া নিচ্ছে ১৮শ’ টাকা আর বড় ট্রাকের ভাড়া নিচ্ছে ২৫শ’ টাকা।
এ হিসাবে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা অবৈধভাবে আদায় করা হয়। পুলিশের দেয়া টাকার এ হিসাব বছর অনুযায়ী যোগ করা হলে দাঁড়ায় প্রায় প্রায় শত কোটি টাকা। এ তথ্যের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছর বেশ কয়েকজন ট্রাকচালক রাজবাড়ি জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগও দেয়। কিন্তু এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি।
অবৈধভাবে আদায়কৃত এ টাকা ভাগবাটোয়ারারও ইঙ্গিত দেয়া হয় প্রতিবেদনে। এ প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘এ টাকার কিছু অংশ পায় গুটিকয়েক রাজনৈতিক উপরওয়ালা ও বিআইডব্লিউটিসির কয়েকজন কর্মকর্তা।
বাকি অংশ জমা হয় নুরু মণ্ডলের কোষাগারে। নুরু মণ্ডলের এ চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে বিআইডব্লিউটিসির কোনো কর্মকর্তা, ট্রাফিক পুলিশ কিংবা অন্য কোনো সেক্টরের কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করে হেনস্থা অথবা বদলি করিয়ে দেয়া হয়।
২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে নুরু মণ্ডল হত্যা, দুর্নীতি, পরিবহনে চাঁদবাজি, মানব পাচার, পতিতালয়ে চাঁদাবাজি, নারী ও শিশু পতিতা ক্রয়-বিক্রয়ের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ বেপরোয়াভাবে বৃদ্ধি পায়। নুরু মণ্ডলের সন্ত্রাসী কার্যাকলাপ ও জুলুম-অত্যাচারের ঘটনায় বিভিন্ন থানায় মামলাও করা হয়।
এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো অভিযোগে দৌলতদিয়া পতিতাপল্লীতে নুরু মণ্ডলের একছত্র আধিপত্যের বিষয়ে বলা হয়, নুরু মণ্ডলের ভাগ্নে মো. জুলহাস মোল্লা নিয়ন্ত্রণ করে মাছ বহনকারী ট্রাকগুলো। কাভার্ড ভ্যান নিয়ন্ত্রণ করে আতিকুজ্জামান সেন্টু।
মো. টোকন সর্দার নিয়ন্ত্রণ করে কাঁচামালের ট্রাক। ফলের গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করে মো. রুবেল মোল্লা এবং মাসেম হোসেন মৃধা নিয়ন্ত্রণ করে ছোট পিকআপ। তাদের প্রত্যেকের অধীনে রয়েছে বিপুল সংখ্যক ক্যাডার।
পতিতাপল্লী নিয়ন্ত্রণ : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অভিযোগে বলা হয়, সরকারি নিয়ম নীতি না থাকলেও দেশের সর্ববৃহৎ পতিতাপল্লীতে প্রবেশে টিকিট বিক্রির মাধ্যমে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা আদায় করে সাঈদ কমান্ডার ও লাল মিয়ার পাহারাদার বাহিনী।
এ পল্লীতে অন্তত সাড়ে ৩ হাজার যৌন কর্মীর বসবাস। এখানে ঢুকতে হলে ৬৪টি সদস্যের পাহারাদার বাহিনীর কাছে থেকে ৪০ টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে হয়। প্রবেশ পথে প্রতিদিন ২-৩ লাখ টাকা টিকিট বিক্রি হয়ে থাকে।
তথাকথিত পাহারাদার বাহিনী প্রকাশ্যে নুরু মণ্ডলের ছত্রছায়ায় চাঁদাবাজির নতুন দোকান খুলে বসেছে। অনেকে আবার ভেতরে ঘুরে ঘুরেও টাকা তোলে। পল্লীর ভেতর থেকে বাইরে এলে তাকে আবারও ৪০ টাকার টিকিট নিয়ে পল্লীতে প্রবেশ করতে হয়।
সরেজমিন গিয়ে এ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। সেখানে নুরু মণ্ডলের দখলে থাকা দুটি বাড়িও রয়েছে। ওই দুই বাড়িতে অন্তত অর্ধশত যৌন কর্মী ভাড়া থাকে। সংশ্লিষ্টদের হিসাবে প্রতিদিন কমপক্ষে সাড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার টিকিট বিক্রি হয়।
তপুর নিয়ন্ত্রণে জুয়ার আসর : যৌন পল্লীতে খড়গুটি, চরকি ও তিন তাসের জুয়ার আসরসহ মাদক বিক্রি ও সেবন নিয়ন্ত্রণ করে নুরু মণ্ডলের মামা তোফাজ্জেল হেসেন তপু। এ সুবাদে পল্লীর ভেতরে দুই জায়গায় যত্রতত্র খড়গুটি, চরকি ও তিন তাসের জুয়া জমজমাট।
জমি দখল করে হ্যাচারি : দৌলতদিয়া ইউনিয়নের মনি সর্দারের পাড়ায় মণ্ডল হ্যাচারি নামে একটি খামার করেছে নুরু মণ্ডল। সেখানে ভূমিহীন ৫ পরিবারের প্রায় ২৪৮ শতক জমি দখল করে মাটি ভরাট করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
রাজবাড়ি পুলিশ সুপারের কাছে দেয়া এসব অভিযোগে বলা হয়, গোয়ালন্দ উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম মণ্ডল দলীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে জোর করে জমি লিখে নেয়ার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে ওই জমি তার হ্যাচারির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে মাটি ভরাটের কাজও শেষ করেছে। তারা ভূমিহীন ও গরিব হওয়ায় প্রতিবাদ করার সাহসও হারিয়ে ফেলেছেন। ভয়ে তারা মুখ খুলতে পারছেন না। দখলকৃত জমির মধ্যে রয়েছে চর দৌলতদিয়ার মো. আবু তালেব বেপারীর ৩৩ শতক, রীবন্দ্রনাথের ৭৫ শতক, আকতার বেপারীর ৬০ শতক, মিলন শিকদারের ১৫ শতক ও আবজাল বেপারীর ৬৫ শতক জমি।