ঢাকা বুধবার, ৭ই মে ২০২৫, ২৫শে বৈশাখ ১৪৩২


বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যার আসামী

মানুষের বাড়ি কাজ করে আকাশের পড়াশুনার খরচ দিতেন মা


১৩ অক্টোবর ২০১৯ ২১:০৪

আপডেট:
৭ মে ২০২৫ ১৮:৩০

জয়পুরহাট সদরের দোগাছি গ্রামের হতদরিদ্র আতিকুল ইসলাম ও নাজমা বেগম দম্পতি। অভাবের সংসারে আতিকুল কখনো ভ্যানচালক, কখনো-বা আবার দিনমজুর। অন্যদিকে নাজমা

কখনো অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ অথবা নিজ বাড়িতে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল লালন-পালন করে সংসার খরচের টাকা জোগাড়ের প্রাণান্ত চেষ্টায় থাকেন। হাড়ভাঙা সেই পরিশ্রমের টাকা এবং পাড়া-প্রতিবেশী বিত্তবানদের আর্থিক সহযোগিতায় বড় ছেলে আকাশ হোসেনকে (২১) ভর্তি করিয়েছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। তার পড়াশোনার খরচ জোগাতে গিয়ে স্থানীয় দুটি ব্যাংক থেকে প্রায় দেড় লাখ টাকা ঋণও নিয়েছিলেন মা নাজমা।

মা-বাবা স্বপ্ন বুনছিলেন আর মাত্র দুই বছর পরই পড়াশোনা শেষে ছেলে আকাশ প্রকৌশলী হয়ে পরিবারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনবে। নবম শ্রেণিতে পড়–য়া ছোট বোন মরিয়ম এবং ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়–য়া ভাই ইয়ামিনকে তার মতো উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবে। কিন্তু হঠাৎই এই দম্পতির জীবনে যেন ঘোর অন্ধকার নেমে আসে, যখন গত মঙ্গলবার টেলিভিশনের খবর দেখে প্রতিবেশীরা তাদের বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় আকাশের গ্রেপ্তারের তথ্য জানায়। তিলে তিলে গড়া তাদের স্বপ্নগুলো যেন মুহূর্তেই ভেঙে চুরমার হয় যায়।

ছেলের গ্রেপ্তারের খবরে বেদনাহত নাজমা বেগম গতকাল শনিবার কান্নাজড়িত কণ্ঠে দেশ রূপান্তরকে জানান, স্থানীয় দোগাছী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১৪ সালে এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ ৫ এবং ২০১৬ সালে জয়পুরহাট সরকারি কলেজ থেকে জিপিএ ৫ পায় আকাশ। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়েই চান্স পায়। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে এমন স্বপ্নে তাকে বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি করা হয়।

আকাশের মা বলেন, ‘তাকে (আকাশ) পড়াতে গিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৪০ হাজার এবং গরু পালনের জন্য কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি। আর দুই বছর পরই আকাশ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সংসারের হাল ধরবে যখন এমন স্বপ্ন দেখছিলাম ঠিক তখনই সব অন্ধকার হয়ে গেল।’

আকাশের অসুস্থ বাবা আতিকুল বলেন, ‘আমাদের জানামতে আকাশ কোনো দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। কিন্তু কেন এত বড় ঘটনায় সে জড়িয়ে গেল? এখন আমার ছোট দুই ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার কী হবে? আল্লাহর কাছে বিচার দেওয়া ছাড়া আমার আর এখন কিছুই করার নেই।’

বড় ভাইয়ের গ্রেপ্তারের খবরে স্বপ্নভঙ্গের বিষণœতা ভর করেছে বোন মরিয়মের মনেও। সে দেশ রূপান্তরকে বলে, ‘ভাইয়া ইঞ্জিনিয়ার হবে, আমি ডাক্তার হবোÑ মনে মনে এমন স্বপ্ন দেখতাম। কিন্ত এখন যেন সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাচ্ছে।’

অন্যদিকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ছোট ভাই ইয়ামিন বলে, ‘স্বপ্ন ছিল আকাশ ভাইয়া ইঞ্জিনিয়ার হবে, আমি সেনাবাহিনীর অফিসার হব। কিন্তু তা বুঝি আর হলো না।’

এলাকায় মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিতি থাকায় আকাশকে নিয়ে গর্ব করতেন তার নানা আব্দুল হামিদ, ফুফু মাসুমা আক্তার ও চাচা আব্দুল মাবুদ। তারা দেশ রূপান্তরকে জানান, বসতবাড়ির ১৬ শতক জমি ছাড়া আকাশদের পরিবারের স্থাবর আর কোনো সম্পদ নেই। যে কারণে তারা সবাই আকাশের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আকাশ যে আবরার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তা এই তিনজনের কেউই বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না। প্রতিবেশী আশরাফ আলী ও মাহফুজুল ইসলামসহ আরও অনেকেরই এমনই ধারণা।

আকাশের সহপাঠী ও বন্ধু মেহেদী হাসান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আকাশ ছুটি পেলেই গ্রামে এসে আশপাশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সম্পর্কে ধারণা ও তাদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করত। সে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। দরিদ্র হওয়ায় আমরাও তাকে সহযোগিতা করতাম। গত ঈদে ছুটিতে বাড়ি এসে ঢাকায় ফেরার খরচের টাকা না থাকায় আমরা তাকে টাকা দিয়েছিলাম। সে কীভাবে এমন ঘটনায় জড়িয়ে গেল, তা আমরা ভাবতেও পারছি না।’

আকাশের সম্পর্কে জানতে চাইলে তার একসময়ের বিদ্যাপীঠ স্থানীয় দোগাছী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আফজাল হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ক্লাস ওয়ান থেকে টেন পর্যন্ত তাকে আমি চিনি এবং পড়িয়েছি। কোনো সময় সে শৃঙ্খলা বহির্ভূত কোনো কাজ করেনি। সে অত্যন্ত নরম স্বভাবের ছেলে, মাথা উঁচু করে কথা বলত না। দরিদ্র পরিবারের হওয়ায় স্কুল ও এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে সহযোগিতার পাশাপাশি আমি ব্যক্তিগতভাবেও তাকে সাহায্য করেছি। তার জড়িত থাকার বিষয়টি ভালোভাবে তদন্ত করা দরকার।’

স্থানীয় দোগাছী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এলাকায় সে (আকাশ) অত্যন্ত ভালো ও মেধাবী ছেলে হিসেবে পরিচিত। আবরার হত্যায় তার জড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি শুনে আমি হতবাক। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তদন্ত চলছে। আবরার হত্যার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের মাধ্যমে নিরপরাধ কেউ যেন শাস্তি না পায় সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।’

গত ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে নিজ কক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় তার বাবা বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের ১৯ নেতাকর্মীকে আসামি করে মামলা করেছেন। এদের মধ্যে জয়পুরহাটের ছেলে আকাশ হোসেন ১৩ নম্বর আসামি। গত বুধবার আদালত তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।