ব্যাংক হিসাব তলব, দেশের বাইরে যেতে নিষেধাজ্ঞা * কোথাও নেই প্রতাপশালী যুবলীগ চেয়ারম্যান * অপকর্ম খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি যুবলীগের
ওমর ফারুক চৌধুরীর পাশে নেই কেউ,নতুন কাউকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা!

প্রভাব-প্রতিপত্তি, হাজারও নেতার উপচে পড়া ভিড় আর বিশাল গাড়িবহরের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। সবাই তাকে ছেড়ে চলে গেছেন। ফলে বাধ্য হয়েই নির্জন-নিভৃতে চলে গেছেন যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী। ক্যাসিনো অভিযান শুরুর পর নানা ধরনের অভিযোগ উঠতে থাকে তার বিরুদ্ধে। ব্যাংক হিসাব তলব ও বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞার পর থেকেই তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে যুবলীগ চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য নেতার সম্পৃক্ততার সত্যতা যাচাইয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করতে যাচ্ছে সংগঠনটি। আজ এ কমিটি গঠন করা হবে বলে যুগান্তরকে জানান যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. আতাউর রহমান। এদিকে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী সংগঠনের সব কার্যক্রম থেকে বিরত আছেন।
আসন্ন জাতীয় কংগ্রেস তার অনুপস্থিতিতেই হতে পারে।
ইতিমধ্যে ৩ বছর মেয়াদি যুবলীগ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব টেনে ৭ বছর পার করেছেন ওমর ফারুক চৌধুরী। যথাসময়ে সম্মেলন করেননি। এবার ২৩ নভেম্বর সংগঠনটির জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ২০১২ সালের ১৪ জুলাই সর্বশেষ জাতীয় কংগ্রেসে যুবলীগের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ওমর ফারুক চৌধুরী।
নিজেকে তরুণ ভাবাপন্ন ৭১ বছর বয়সী ওমর ফারুক চৌধুরী যুবলীগের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই একক ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। শুরুতে সাবেক নেতাদের পরামর্শ ছাড়াই একটি ঢাউস কমিটি গঠন করেন তিনি। অভিযোগ আছে, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তিনি অনেক নেতাকে কমিটিতে স্থান দিয়েছেন। পদভেদে ১০ লাখ থেকে শুরু করে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। ফ্রিডম পার্টি ও যুবদলের অনেকে টাকার বিনিময়ে ঠাঁই পেয়েছেন যুবলীগে বলেও অনেকে অভিযোগ করেন।
যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতা জানান, বিগত সাত বছরে তারা চেয়ারম্যানের ভয়ে তটস্থ ছিলেন। মুখ বুজে সব অপকর্ম সহ্য করেছেন। সংগঠনে সব সিদ্ধান্ত তিনি এককভাবে নিয়েছেন। আমাদের শুধু সম্মতি দিতে হয়েছে। তার সিদ্ধান্তের বিপক্ষে মত দিলেই তাৎক্ষণিক বহিষ্কার, অফিসে আসতে বারণ পর্যন্ত করা হয়েছে। তারা বলেন, তার সব অপকর্ম জায়েজ করার মেশিন ছিল যুব জাগরণ প্রকাশনা। এখান থেকে নানা বই ও প্রকাশনা বের করে সবার কাছে ভালো সাজার চেষ্টা করতেন। পুরো সাত বছরে যুবলীগ বলতে আমরা শুধু তাকেই বুঝতাম।
এদিকে ক্যাসিনো-কাণ্ডে যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর নাম আলোচনায় আসায় দীর্ঘ ৭ বছর ধরে কোণঠাসা নেতারা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। শুক্রবার অনুষ্ঠিত সংগঠনটির প্রেসিডিয়াম বৈঠকে তাকে বহিষ্কার ও নতুন কাউকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্বভার দেয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আসন্ন জাতীয় কংগ্রেসে তিনি যাতে সভাপতিত্ব করতে না পারেন তা নিয়ে অনেকেই কথা বলেছেন। চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয় সেখানে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ওমর ফারুক চৌধুরীর বিরুদ্ধে হাজারও অভিযোগ জমেছে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে। দলীয় পদবাণিজ্যের অভিযোগ, স্বেচ্ছাচারিতা, ইচ্ছামাফিক পদ দেয়া-পদ বাতিল করা ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে অসদাচরণ ছিল তার নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার। সর্বশেষ সম্রাটের ক্যাসিনোর ভাগ পেতেন বলেও অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। যুবলীগের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ক্যাসিনোতে সম্পৃক্ত ‘বিস্ময়কর’ এবং সংগঠনটির জন্য বড় ধাক্কা বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের অনেক নেতা।
যুবলীগ নেতাদের বিভিন্ন অপকর্মের কারণে সংগঠনটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে জানান কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. আতাউর রহমান। তিনি বলেন, আমরা শুনেছি, ক্যাসিনো ঘটনায় আমাদের সংগঠনের অনেকেই জড়িত। এতে আমরা বিব্রত ও অসম্মান বোধ করছি। অপকর্মে জড়িতদের সত্যতা যাচাইয়ে একটি তদন্ত কমিটি রোববার (আজ) গঠন করা হবে।
শুক্রবারের বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতি নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেন প্রেসিডিয়াম সদস্যরা। প্রেসিডিয়াম সদস্য আতাউর রহমান আতা, মাহবুবুর রহমান হিরণ, মো. ফারুক হোসেন অভিন্ন সুরে বলেন, যেহেতু উনি (ওমর ফারুক) নেই, তাহলে সিদ্ধান্ত নিতে কেন পারব না? ব্যক্তির দায় সংগঠন বহন করতে পারে না। উনি উপস্থিত না হলে কাউকে না কাউকে তো সভাপতিত্ব করতে হবে। তার নামে নানা ধরনের সংবাদ সংগঠনের সুনাম ক্ষুণ্ণ করেছে। ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ সময় আলতাফ হোসেন বাচ্চু বলেন, যেহেতু উনি নেই, তাই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।
ক্যাসিনো-কাণ্ডের শুরুতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াসহ তিন নেতার গ্রেফতারের পর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন যুবলীগ চেয়ারম্যান। তিনি ওই ঘটনাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করেন। প্রশাসনকেও দুষেছেন। যুবলীগের প্রশ্নবিদ্ধ নেতাদের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন। এর পরের দৃশ্যপট অন্যরকম। এরপর থেকেই তাকে প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না।
যুবলীগের প্রেসিডিয়ামের কয়েক নেতা বলেন, চেয়ারম্যানের আশকারায় দলে অনেক দুর্বৃত্ত ডালপালা ছড়িয়ে ফেলার সুযোগ পেয়েছে। তারা কেন্দ্রীয় কমিটিসহ, সারা দেশের জেলা-উপজেলা কমিটি গঠনের ক্ষেত্রেও পদবাণিজ্য করে। দায়িত্বশীলদের এড়িয়ে একমাত্র দফতর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমানের শলা-পরামর্শেই চূড়ান্ত হতো চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ সব কার্যক্রমের বিষয়ে সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ পর্যন্ত অন্ধকারে থাকতেন। বর্তমান ও সাবেক একাধিক নেতা জানান, ২০১২ সালে ষষ্ঠ কংগ্রেসে ওমর ফারুক চৌধুরী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে যুবলীগের ঐতিহ্য বিলীন হতে শুরু করে। অর্থের বিনিময়ে দলে ঢুকে পড়ে বিভিন্ন এলাকায় বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য বিতাড়িতরাও। অর্থের বিনিময়ে দলে অযোগ্য ও প্রশ্নবিদ্ধ অনেক ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন সংগঠনের চেয়ারম্যান।