ঢাকা বুধবার, ৭ই মে ২০২৫, ২৫শে বৈশাখ ১৪৩২


ভয়ে আছেন ৪০ কাউন্সিলর


১৭ অক্টোবর ২০১৯ ১৩:৩১

আপডেট:
৭ মে ২০২৫ ০৭:৩৬

ক্যাসিনো ও মাদক কারবার, টাকা পাচার, দখল, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অনিয়ম এবং দুর্নীতির অপরাধে অভিযুক্ত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৩০ থেকে ৪০ কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে শিগগিরই অভিযান শুরু হচ্ছে। অভিযানের খবর টের পেয়ে এর মধ্যে অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন এবং কেউ কেউ বিদেশে চলে গেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।

দুই সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, ক্যাসিনোকা-ে যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট ও খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পরই তাদের ঘনিষ্ঠ সব কাউন্সিলর গা ঢাকা দিয়েছেন। তাদের এখন আর এলাকায় দেখা যায় না এবং তারা বোর্ড সভায়ও আসেন না।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং দুদক সূত্রের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা ও একাধিক সংস্থার মাঠ জরিপ থেকে দুই সিটির ৭০ কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৪০ জনের বিরুদ্ধে ক্যাসিনো, টাকা পাচার এবং হিন্দু সম্পত্তি, সরকারি জায়গা ও অবৈধ দখলের গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। দুই সিটির মেয়র সাঈদ খোকন ও আতিকুল ইসলামের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নিজে কাউন্সিলরদের সম্পর্কে পাওয়া এসব অভিযোগ নিয়ে কথা বলেছেন। ডেঙ্গু নিয়ে তিনি মেয়র ও কাউন্সিলরদের ভূমিকা জানতে চেয়েছেন। গত আগস্টে যুক্তরাজ্যে সফরকালীন সময়ে তিনি স্থানীয় সরকারমন্ত্রী, দলের সাধারণ সম্পাদক এবং শীর্ষ নেতাদের কাছে মেয়র ও কাউন্সিলরদের কর্মকা-ের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এরপর গত মাসে দুই মেয়রের সঙ্গে আলাদা কথা বলে তার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সম্রাট ও খালেদের অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাউন্সিলররা কাজ করতেন। দলীয় নেতাকর্মীদের কাছ থেকে পর্যন্ত চাঁদাবাজি করতেন।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন অপরাধে গ্রেপ্তার মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া রিমান্ড থেকে কাউন্সিলরদের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকার সব অপরাধের

সঙ্গেই দুই সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররা যুক্ত। এসব অপরাধে তারা সিন্ডিকেটভুক্ত হয়ে কাজ করে। খালেদের কাছ থেকে তারা এ পর্যন্ত ২৩ কাউন্সিলরের নাম পেয়েছেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনেরও এদের নাম রয়েছে।

ঢাকা উত্তরের ২ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, তাদের ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আনিসুর রহমান নিজ দলের লোকজনের কাছ থেকেও চাঁদা নিতেন। তার বিরুদ্ধে ক্যাসিনোয় যুক্ত থাকারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, এসব কাউন্সিলর মন্ত্রী, এমপির প্রভাব দেখিয়েও এলাকায় দখলবাজি করেছেন। ডিএসসিসির ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসান পিল্লু স্থানীয় সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ভাগিনা। পুরান ঢাকা সোয়ারীঘাটসহ পুরো এলাকা তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন।

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যমতে, কাউন্সিলর মোবাশ্বের হোসেন চৌধুরী, ফরিদুর রহমান খান ওরফে ইরান, তারেকুজ্জামান রাজীব, আশ্রাফুজ্জামান, এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ, মোস্তফা জামান (পপি), ফরিদউদ্দিন আহম্মেদ রতন, মো. তরিকুল ইসলাম সজীব, মো. হাসান (পিল্লু), ময়নুল হক মঞ্জু, গোলাম আশরাফ তালুকদার, জসীম উদ্দিন আহমেদ, মো. আনোয়ার পারভেজ বাদল, মো. বিল্লাল শাহ ও আউয়াল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখছে। আর কোনো কাউন্সিলর যদি দ-িত হন তাহলে আমাদের ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ওরফে ইরানের বিরুদ্ধে দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও সশস্ত্র মহড়া দেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। তিনি যেন এই ওয়ার্ডের ‘অঘোষিত রাজা’। তার কথাই যেন সেখানে আইন। ফুটপাতের দোকান থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবখানেই চলে ইরান বাহিনীর চাঁদাবাজি। ইরান নিজেও সবসময় চলেন সশস্ত্র ক্যাডার পরিবেষ্টিত হয়ে। ভয়ে এলাকার কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পান না।

ঢাকা উত্তরের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রাজীবের বাড়ি ভোলায়। তার বাবা তোতা মিয়া ও চাচা ইয়াসিন মিয়া মোহাম্মদপুর এলাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। রাজীব ছিলেন দোকানদার। ২০১৪ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কাউন্সিলর হওয়ার পর দ্রুতই তার ‘ভাগ্য বদল’ হয়েছে। চাঁদাবাজি ও অবৈধ দখলের মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হন রাজীব ও তার পরিবারের লোকজন।

ঢাকা উত্তরের ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সলুর ভগ্নিপতি নূরুল ইসলাম রতনের বিরুদ্ধেও দখল, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযাগ রয়েছে।

ঢাকা উত্তরের ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর রজ্জব হোসেন যেন রূপনগরের অঘোষিত রাজা। রূপনগরের ঝিলপাড় বস্তি থেকে অবৈধ গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ও ডিশলাইন থেকে মাসে আয় হতো অন্তত ২ কোটি টাকার বেশি। রূপনগর ও আশপাশ এলাকার পরিবহন থেকে চাঁদা তোলা ও মাদক কারবারিদের সহায়তারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। একসময় পরিবহন শ্রমিক থেকে এখন বিপুল সম্পদের মালিক রজ্জব। তার মালিকানাধীন একাধিক সুরম্য বাড়ি ও গাড়ি রয়েছে। অল্প সময়ে এত সম্পদের নেপথ্যে রয়েছে তার দখলদারিত্ব আর চাঁদাবাজি।

মাত্র দেড় দশকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ওয়ার্ড কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদের বিস্ময়কর উত্থান হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থেকে বঙ্গভবনের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মামার হাত ধরে ২০০২ সালে ঢাকায় আসেন তিনি। দিলকুশা এলাকায় চোরাই তেলের কারবার শুরু করেন। এখন তিনি শতকোটি টাকার মালিক। শুধু মতিঝিলের ক্লাবপাড়া থেকেই প্রতিদিন তার আয় ছিল ২০ লাখ টাকারও বেশি। এছাড়া ক্যাসিনো-জুয়ার আসর চালানো, ফুটপাতে চাঁদাবাজি, ফ্ল্যাট, দোকান, মার্কেটসহ বিভিন্ন স্থাপনা দখল, টর্চার সেলে ধরে নিয়ে নির্যাতনসহ তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। তাকে এখন মতিঝিলের লোকজন চেনেন ক্যাসিনো সাঈদ নামে।

অভিযোগ রয়েছে, ডিএসসিসির ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ময়নুল হক মঞ্জুর রাজধানী সুপার মার্কেট ও নিউ রাজধানী সুপার মার্কেট থেকেই মাসে কোটি টাকার বেশি আয়। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ২০১১ সাল থেকে টানা আট বছর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের আওতাধীন টিকাটুলীর এই মার্কেটের ‘স্বঘোষিত’ সভাপতি তিনি। তার বেপরোয়া চাঁদাবাজি ও দখলবাজির বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও র‌্যাব সদর দপ্তরসহ বিভিন্ন স্থানে বছরের পর বছর অভিযোগ ও মামলা করেও কোনো লাভ হয়নি।

ঢাকা দক্ষিণের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিকের নামেও রয়েছে দখল ও চাঁদাবাজির বিস্তর অভিযোগ।