ঢাকা বুধবার, ৭ই মে ২০২৫, ২৫শে বৈশাখ ১৪৩২


ভাইয়েরা (সম্রাট-খালেদ) অচিরেই বের হবে’ বলে হুমকি দিয়ে আগের মতই প্রভাব ও আতঙ্ক সৃষ্টি করছে তার সহযোগীরা।

সম্রাট-খালেদর অনুসারীদের থেমে নেই চাঁদাবাজি


১৯ অক্টোবর ২০১৯ ১১:৫৯

আপডেট:
৭ মে ২০২৫ ০৯:৩২

যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার মতো গডফাদাররা গ্রেফতার হয়ে বন্দি থাকলেও তাদের বিচরণভূমিতে থেমে নেই চাঁদাবাজি। আগে যেভাবে চলেছে, এখনও প্রায় সেভাবেই চলছে খাত অনুযায়ী নীরব চাঁদাবাজি।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে- চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে কৌশলগত কিছু পরিবর্তন আনা হলেও আগে যারা মাঠ পর্যায়ে চাঁদাবাজির টাকা ‘কালেকশন’ করত, এখনও তারাই করছে। যাদের নেপথ্যের শেল্টারদাতা হিসেবে ছিলেন সম্রাট-খালেদের মতো কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা। ‘ভাইয়েরা (সম্রাট-খালেদ) অচিরেই বের হবে’ বলে হুমকি দিয়ে আগের মতই প্রভাব ও আতঙ্ক সৃষ্টি করছে তার সহযোগীরা।

সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে সম্রাট-খালেদরা নেপথ্যে থেকেই মূলত তাদের অনুসারীদের দিয়ে এলাকা বা সেক্টরভিত্তিক চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন। ফলে সম্রাট-খালেদ না থাকলেও তাদের অনুসারীরা তাদের অপকর্মের দায়িত্ব যথাযথভাবেই পালন করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এই সিন্ডিকেট বর্তমানে রাজধানীর মতিঝিল, আরামবাগ, ফকিরাপুল, পল্টন, গুলিস্তান, এজিবি কলোনি, শাহজাহানপুর বস্তি, খিলগাঁও ও গুলিস্তানের লেগুনা স্ট্যান্ড, শাহজাহানপুরের ৬টি ক্লাব, রেলওয়ে কোয়ার্টার থেকে শুরু করে আশপাশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিস, ফুটপাথ ও পরিবহন সেক্টরে নিয়মিত চাঁদাবাজি করে যাচ্ছেন। এ ছাড়া ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ভবন, গণপূর্ত, সড়ক ও জনপদ ভবন, ওয়াসা, রেল ভবন, তিতাস, এলজিইডিসহ সেবামূলক বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানে এখনও রয়েছে সম্রাট-খালেদ ও জিকে শামীমের অদৃশ্য প্রভাব।

তাদের অনুসারীরা সম্রাট-খালেদদের দ্রুতই মুক্তি হবে এবং ফিরে এলে কি হবে তা স্মরণ করানোর মাধ্যমে ভয় দেখিয়ে এখনও নানা কাজ বা অপকর্ম করা হচ্ছে এবং নানা অবৈধ সুবিধা বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।

গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার মতিঝিল, কমলাপুর, গুলিস্তানসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ব্যবসায়ী ও স্থানীয় পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছেÑ অবৈধ ক্যাসিনো, জুয়া ও চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির হোতা হিসেবে পরিচিত যুবলীগ নেতা সম্রাট, খালেদ ও আরমানসহ কয়েকজন প্রভাবশালী গ্রেফতার হলেও তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এসব এলাকায় আগের মতই চাঁদাবাজি চলছে। সম্রাট-খালেদদের মাঠ পর্যায়ের সহযোগীরা এখনও আগের মতই তৎপর রয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সম্রাট ও খালেদ ভূঁইয়ার অবর্তমানে এখন চাঁদাবাজির তদারকি করে যাচ্ছেন যুবলীগ নেতা কবির, রিপন, রিদি, কিসলু, সেলিম, রনি, মহিবুল হক হিরুক, আমিনুল, রুবেল মাসুদ, মাজহারুল ইসলাম তুহিন, মিজান, খায়রুল, জাহিদুল ইসলাম টিপু ও আলাউদ্দিন লিটনসহ অর্ধশতাধিক নেতা।
অভিযোগ রয়েছেÑ মতিঝিল, গুলিস্তান, পল্টন, রমনা ও আরামবাগসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় সম্রাট-খালেদদের এই অনুসারীরা এখনও তৎপর রয়েছে। আগে যেভাবে প্রকাশ্যে তারা চাঁদাবাজি করতেন এখন সেটির কৌশল কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। ভুক্তভোগীদেরও মুখ না খুলতে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে।

শাহজাহানপুরের ৪টি বস্তি, ৯টি গাড়ির গ্যারেজ ও ৫টি ক্লাব থেকে প্রতি মাসে প্রায় কোটি টাকার ওপরে চাঁদা তোলা হতো।
এ টাকা যুবলীগের খালেদের কথা বলে প্রকাশ্যে তুলছে তার লোকজন। এখন বলা হচ্ছে ‘খালেদ ভাই বের হবে’ এমন কথা বলে আগের মতো করেই টাকা তোলা হচ্ছে। পাশাপাশি মতিঝিল এজিবি কলোনির পাশে আইডিয়াল স্কুল ও কলেজের সামনে বসা হলি ডে মার্কেট থেকেও বিপুল পরিমাণ টাকা চাঁদাবাজি করা হয়। যুবলীগ নেতা সম্রাটের অবৈধ ক্যাসিনো কারবার দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী যুবলীগ নেতা এনামুল হক আরমান এবং ইয়াবা ও চাঁদাবাজি দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন সাগর। সম্রাটের ব্যবসা দেখভালের জন্য সাগরকে সহযোগিতা করতেন তার চাচা টুটুল। গত ১৮ সেপ্টেম্বর খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া গ্রেফতারের পর থেকে সাগর ও টুটুল পলাতক বলে জানা গেছে।

পরিবহন খাতের একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঢাকায় যেকোনো ব্যবসা করতে গেলেই যুবলীগ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাদের টাকা দিয়ে খুশি রাখতে হয়। পরিবহন ব্যবসার ক্ষেত্রে এ অবস্থা আরও বেশি গুরুতর। নতুন কোনো বাস কোম্পানি বা নতুন রুট হিসেবে কোনো বাস চলাচল করলে গাড়ি মালিকদের এই রাজনীতিকদের মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হয়। টাকা না দিলে গাড়ি চলাচলে তারা নানা ধরনের বাধা সৃষ্টি করে থাকে। ‘শুদ্ধি অভিযান’ শুরুর আগেও যেভাবে চাঁদাবাজি হয়েছে, এখনও প্রায় সেভাবেই হচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে এসব রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে লুকিয়ে থাকা চাঁদাবাজদের বিষয়ে ভয় কাটেনি বলেও মন্তব্য করেন ওই পরিবহন ব্যবসায়ী।

প্রসঙ্গত, বিভিন্ন স্পোর্টস ক্লাবের আড়ালে গড়ে ওঠা অবৈধ ক্যাসিনো বা জুয়া ব্যবসা চালানোর অভিযোগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে সরকারের কঠোর বার্তা নিয়ে অভিযান শুরু করে র‌্যাব। এরই ধারাবাহিকতায় ওইদিনই গ্রেফতার করা হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে। এর দুই দিন পর গ্রেফতার করা হয় যুবলীগ নেতা ও টেন্ডার কিং হিসেবে পরিচিত জিকে শামীমকে। অভিযান শুরুর দিন থেকেই আলোচনায় আসেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি প্রভাবশালী নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট। কেননা খালেদ বা আরমানসহ অনেকেরই মাথার ছায়া হিসেবে ছিলেন সম্রাট। ঢাকার চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিসহ নানা অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতেন সম্রাট-খালেদদের মতো কিছু হোতা।

অবশ্য এদের নেপথ্যেও আবার একাধিক প্রভাবশালী রাজনীতিক, মন্ত্রী-এমপি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আশীর্বাদ ছিল বলেও শোনা যায়। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিক অনুষ্ঠানে বলেছেন, অপকর্মে যেই জড়িত থাকুক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।