‘অমিতের উসকানিতেই হিংস্র হয়ে ওঠে হামলাকারীরা’

আবরার ফাহাদ রাব্বীকে (২২) পিটিয়ে হত্যার নেপথ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শাখা ছাত্রলীগের উপ-আইনবিষয়ক সম্পাদক অমিত সাহার উসকানি ছিল। ৬ অক্টোবর রাতে তাকে পিটিয়ে হত্যার বেশ কিছু দিন আগে থেকেই তিনি বুয়েট শাখা ছাত্রলীগ নেতাদের বলে আসছিলেন, ‘আবরার একজন শিবির। তাকে শিক্ষা দেওয়া দরকার।’ তার ওই উসকানি পেয়েই শেরেবাংলা হল শাখা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাকে খুঁজতে শুরু করেন।
গতকাল শুক্রবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) একাধিক কর্মকর্তা এসব তথ্য জানিয়েছেন। তারা জানান, বুয়েট ছাত্রলীগের ‘সিক্রেট মেসেঞ্জার’ গ্রপে আবরার বিষয়ে অমিত সাহা এসব কথা বলার পর তারা সবাই তার প্রতি হিংস্রভাবাপন্ন হয়ে ওঠেন। তা ছাড়া অমিতের নির্দেশনাও সব সময় কঠোরভাবে মেনে চলতেন নেতাকর্মীরা। তবে আবরারকে হত্যার উদ্দেশ্যে পেটানো হয়নি বলে ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে দাবি করেছেন অমিত সাহা।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, আবরার হত্যায় গ্রেপ্তার ২০ জনের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তারা প্রত্যেকেই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য দিয়েছেন। ডিবির আরেক কর্মকর্তা বলেন, আবরার হত্যাকাণ্ডে বুয়েট ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে অমিত অন্যতম। অমিত আবরার হত্যায় পেছন থেকে প্রযুক্তির মাধ্যমে কলকাঠি নেড়েছেন। অন্যরা তার কথায় উৎসাহিত হয়েছেন।
এ কাজে অমিতকে বেশি সহযোগিতা করেন তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর। প্রথম দফায় তারা অনেক তথ্য লুকিয়েছিলেন। পরে অন্য আসামিদের দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করার জন্য তাদের দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট অপর এক কর্মকর্তা জানান, বুয়েট ছাত্রলীগের একটি সিক্রেট মেসেঞ্জার গ্রপের কর্মকাণ্ড নিয়ে তারা তদন্ত করছেন। আবরারকে হত্যার আগে এসবিএইচএসএল (শেরে বাংলা হল ছাত্রলীগ) নামের ওই গ্রপের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অমিত। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘আবরার একজন শিবির। সব সময় সরকারবিরোধী কথাবার্তা বলে। তার আসলে একটা শিক্ষা হওয়া দরকার।’ এ কথাই বেশ কিছুদিন দিন ধরে ছাত্রলীগ নেতাদের বলে আসছিলেন অমিত সাহা।
এমন পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগ নেতারা তাকে ‘শিক্ষা’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ বিষয়ে ক্যান্টিনে একটি বৈঠকও করেন তারা। তারপর বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন মেসেঞ্জারে লেখেন, ‘সেভেন্টিনের আবরার ফাহাদ। মেরে হল থেকে বের করে দিবি দ্রত। এর আগেও বলেছিলাম। তোদের তো দেখি বিগার নাই। শিবির চেক দিতে বলেছিলাম। দুই দিন টাইম দিলাম।’ এরপর একজন সেখানে লেখেন, ‘ওকে ভাই।’ মেহেদী তখন আবারও লেখেন, ‘দরকার হলে ১৬ ব্যাচের মিজানের সঙ্গে কথা বলবি।
ও তার সঙ্গে শিবিরের ইনভলভমেন্ট থাকার প্রমাণ দিবে।’ মেসেঞ্জার গ্রæপে ৬ অক্টোবর রবিবার রাত ৭টা ৫২ মিনিটে সবাইকে হলের নিচে নামার নির্দেশ দেন মনিরুজ্জামান মনির। এর আগে মেসেঞ্জার গ্রæপে আবরারের সঙ্গে শিবিরের সংশ্লিষ্টতা থাকার কিছু স্ক্রিন শট সেখানে দেয়। স্ক্রিন শট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রæপের সবাই সেখানে লাইক দেন। রাত ৮টা ১৩ মিনিটে আবরারকে নিজ কক্ষ থেকে ডেকে করিডর দিয়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে নিয়ে যান সাদাত, তানিম, বিল্লাহসহ কয়েকজন। রাত ১টা ২৬ মিনিটে ইফতি মোশাররফ সকাল মেসেঞ্জারে লেখেন, ‘মরে যাচ্ছে, মাইর বেশি হয়ে গেছে। এখন আমরা কী করব?’ রবিন বলে, শিবির বলে পুলিশের হাতে তুলে দে।’
গত ৬ অক্টোবর রাতে আবরারকে তার শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষ থেকে ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে পিটিয়ে হত্যা করেন ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। আলোচিত এ ঘটনায় আবরারের বাবা মো. বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে ১৯ জনকে আসামি করে চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এজাহারভুক্ত ১৯ আসামির মধ্যে ১৬ জন এবং সন্দেহভাজন হিসেবে ৫ জনসহ মোট ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৬ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। তারা হলেন ইফতি মোশাররফ সকাল, মেফতাহুল ইসলাম জিওন, অনিক সরকার, মোজাহিদুর রহমান, মেহেদী হাসান রবিন ও মনিরুজ্জামান মনির। এজাহারভুক্ত তিন আসামি মো. জিসান, মো. মোর্শেদ ও মো. তানিমকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।