সম্রাটের ২০ আশ্রয়দাতা নজরদারিতে, যেকোন মুহুর্তে গ্রেফতার

ক্যাসিনোকান্ডে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী একই কমিটির বহিষ্কৃত সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমানের কাছ থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে ‘হতবাক’ তদন্ত সংস্থাগুলো।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রিমান্ডে সম্রাট তার মূল আশ্রয়দাতাদের নাম বলছেন। তাদের সংখ্যা অন্তত ২০ জন। আশ্রয়দাতাদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দল ও দলটির সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারা আছেন, আছেন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। ইতিমধ্যে প্রোফাইল সংগ্রহের পাশাপাশি নজরদারির আওতায়ও আনা হয়েছে তাদের।
উচ্চপর্যায়ের ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেলে যেকোনো সময় তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। পুলিশ ও র্যাবের দুই কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, পুলিশ কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের লোকজন পদোন্নতি পেতেও সম্রাটের কাছে নিয়মিত ধরনা দিতেন। যারা তার কাছে যেতেন তাদের নামও তিনি বলেছেন। তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছেন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা।
র্যাবের হেফাজতে থাকা সম্রাট ও আরমানকে দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এর আগে ডিবি পুলিশ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। রিমান্ডে সম্রাট ও আরমানের দেওয়া তথ্য যাচাই করতে যুবলীগ নামধারী ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম (জি কে শামীম) ও যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে আবারও রিমান্ডে নেবে তদন্ত সংস্থাগুলো। পরে তাদের চারজনকে মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ প্রসঙ্গে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম জানান, ক্যাসিনো কারবার, আন্ডারওয়ার্ল্ড, অস্ত্র, মাদক, অবৈধ অর্থ, জবর-দখলসহ সব অপকর্ম নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে সম্রাট ও আরমানকে। তাদের দেওয়া তথ্য যাচাই করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘদিন ধরেই সম্রাট, খালেদ, শামীম ও আরমান চাঁদাবাজি, ক্যাসিনো কারবার ও টেন্ডারবাজিসহ নানা অপরাধ করে আসছিল। তাদের সহায়তা করেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরা। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তারাও তাদের সহায়তা করেছেন।
বিনিময়ে তারা পেয়েছেন মোটা অংকের কমিশন। খালেদ ও শামীমকে কয়েকদফা রিমান্ডে জানিয়েছেন, টেন্ডার জমা দিলেই সব সেক্টরের লোকজনকে কমিশন দিতে হতো। কমিশন না দিলে কাজ পাওয়া যেত না। যাদের বেশি কমিশন দেওয়া হতো তারমধ্যে রেলপথ ও গণপূর্ত অধিদপ্তর এবং ক্রীড়া পরিষদের কতিপয় প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা রয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক র্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট ও আরমান দেশের বাইরে অর্থ পাচারের অনেক তথ্য দিচ্ছেন। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও থাইল্যান্ডে অর্থ পাচার করেছেন তারা। তাদের সঙ্গে আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের যোগাযোগ ছিল। সম্রাট জানিয়েছেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে কমিশন ও এলাকার দখল নিয়ে বছরখানেক ধরে বিরোধ চলছিল। জিসান ও তার লোকজন তাকে প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, সম্রাট, শামীম, খালেদ ও আরমানকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে নানাভাবে সহায়তা করেছেন অন্তত ২০ ‘প্রভাবশালী’। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের বেশ কয়েকজন নেতা রয়েছেন। আছেন পুলিশ কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের বেশ কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাদের ব্যাপারে সরকারের হাইকমান্ডকে অবহিত করা হয়েছে। তাদের নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। ওপরের ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেলে যেকোনো সময় তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এক কর্মকর্তা বলেন, সম্রাট ও আরমানকে একদিন জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ পেয়েছি আমরা। তারপর র্যাব তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। আমাদের জিজ্ঞাসাবাদেও তারা কৌশলে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। বিশেষ করে সম্রাট অসুস্থ থাকায় তাকে সাবধানে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
তিনি বিদেশে অর্থপাচারের পাশাপাশি অবৈধ সম্পদের বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন। তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। প্রমাণ মিললে সম্রাটের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করা হবে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ১৮ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া শুদ্ধি অভিযানে এই পর্যন্ত ২২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তারমধ্যে সম্রাট, খালেদ, শামীমসহ ৮ জন প্রভাবশালী আছেন। এই সময়ে ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি থানায় ২৭টি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে মাদক ও অস্ত্র আইনে হওয়া ১১ মামলা তদন্ত করছে র্যাব। মানি লন্ডারিং আইনের ৮ মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তিনি বলেন, জি কে শামীম ও খালেদ মাহমুদকে আবারও রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তাদের সঙ্গে সম্রাট ও আরমানকে মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সংস্থার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সম্রাটকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তেমন বেগ পেতে হচ্ছে না। প্রশ্ন করলেই বলে দিচ্ছেন। যারা তাকে আশ্রয়-প্রশয় দিয়েছিলেন, তাদের তিনি নিয়মিত মোটা অংকের অর্থ দিতেন।
পুলিশ কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের লোকজন ‘প্রমোশন পেতে’ সম্রাটের কাছে তদবির করতেন। কারণ তার সঙ্গে সরকারের প্রভাবশালী নেতা ও প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সুসম্পর্ক ছিল। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে সম্রাট যেসব ‘গডফাদারের’ নাম বলেছেন তাদের নাম খালেদ এবং শামীমও বলেছেন। তাদের মধ্যে সাত জন সংসদ সদস্য এবং যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের ৮ নেতার নাম আছে। বাকি পাঁচজন প্রশাসনের। তবে এই আশ্রয়দাতাদের সংখ্যা বাড়তে পারে। আমরা তাদের নজরদারিতে রেখেছি। যেকোনো সময় গ্রেপ্তার করা হবে।