থেমে নেই যুবলীগ নেতা সাগরের ইয়াবা ও অস্ত্রের ব্যবসা

থেমে নেই যুবলীগ নেতা মারুফ রেজা সাগর বা ক্যাডার সাগরের ইয়াবা ও অস্ত্রের ব্যবসা এবং টেন্ডার ও চাদাঁবাজি। জানা যায় সম্রাটের ক্যাসিনো ব্যবসার পাশাপাশি ছিলও। এ ব্যবসা দেখভাল করত তার অন্যতম সহযোগী যুবলীগের মারুফ রেজা সাগর বা ক্যাডার সাগর। যাকে সবাই মতিঝিল ও ফকিরাপুল এলাকায় সম্রাটের ক্যাডার নামে চিনত।
অনেকে আবার ইয়াবা সাগর হিসেবেও চেনে। সম্রাটের ইয়াবা ব্যবসা চলত ক্যাসিনোর আড়ালে। মতিঝিল, গুলিস্তান, আরামবাগ, শাহজাহানপুর ও ফকিরাপুল এলাকার ১০টি ক্লাবে সরবরাহ করা হতো এই ইয়াবা।
এসব ইয়াবা চট্টগ্রাম থেকে একটি ট্রেনে করে ঢাকায় আনা হতো। সেই ইয়াবা কমলাপুর স্টেশন হয়ে চলে যেত সাগরের হাতে। পুরো ইয়াবা ব্যবসা দেখভালের দায়িত্বই ছিল সাগরের নিয়ন্ত্রণে। সম্রাট তার ইয়াবা ও ক্যাসিনোর পাশাপাশি অস্ত্রের ব্যবসাও চালাতেন। অস্ত্র কিনে তা বিভিন্ন সন্ত্রাসীর কাছে ভাড়া দেওয়ার দায়িত্বে ছিল সাগরের।
প্রতিটি ক্লাবেই রাখা হতো অস্ত্র। আর এসব অস্ত্রভান্ডারের দায়িত্বে ছিল গুলশানে নিহত বায়েজিদ মিল্কীর দেহরক্ষী ও বর্তমানে সম্রাটের ক্যাডার সাগর। মতিঝিলে মিল্কী ক্লাব নামে একটি ক্লাবও করা হয়েছে। সেখানেই রাখা হতো এসব অস্ত্র ও ইয়াবা। এছাড়াও রেল কলোনিতে তিনটি গোডাউন ছিল।
চট্টগ্রাম থেকে ইয়াবা আনার পর তিনটি গোডাউনে সেগুলো মজুদ রাখা হতো। তবে অভিযান চালিয়ে সেই তিনটি গোডাউন ধ্বংস করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ২০১৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে এজিবি কলোনির একটি ভবনের (১৭-বি) সামনে যুবলীগকর্মী রিজভী হাসান বাবু ওরফে বোচা বাবুকে হত্যা করা হয়। ওই মামলায় বাবুর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ১০নং ওয়ার্ডের যুবলীগ সভাপতি মারুফ রেজা সাগরও (৩৫) অন্যতম আসামি ছিল। পরে তাকে ছাড়িয়ে আনেন সম্রাট। মতিঝিল, আরামবাগ ও শাহজাহানপুরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সম্রাটের অন্যতম সহযোগী সাগরের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে। সেও এক সময় বেকার ছিল। কিন্তু সম্রাটের সহযোগী হওয়ার পর থেকে তার লাইফস্টাইল বদলে যেতে থাকে। সাগরের কাজ ছিল, কমলাপুর স্টেশন থেকে ইয়াবাগুলো সংগ্রহ করা। এরপর সেগুলো নিজের কাছে রেখে ক্লাবগুলোতে সরবরাহ করত।
ইয়াবাগুলো ক্লাবে গ্রহণ করে বিলি, বিক্রি ও বণ্টনের বিষয়টি বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে দেখভাল করতেন যুবলীগের গ্রেফতার হওয়া নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। মূলত কয়েকজনকে নিয়ে ইয়াবার ব্যবসাটা চালাত সাগর। আরও ছিল আওয়ামী লীগ নেতা সেন্টু, টুটুল, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা মনির ও কমলাপুর রেল কলোনির যুবলীগের নেতা শরীফ। মনির ও শরীফ খালেদের ক্যাডার; কিন্তু তারা সম্রাটকেও নানাভাবে সহযোগিতা করত।
জানা গেছে, সম্রাট শুধু ক্যাসিনো ও ইয়াবার ব্যবসা করতেন না, তার ছিল অস্ত্রের ব্যবসা। অস্ত্রগুলো রাখা হতো সাগরের কাছে। এসব অস্ত্র নিজের কাছে রেখে প্রতিদিন ভাড়াও দেওয়া হতো। নগরীর বিভিন্ন ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা এসব অস্ত্র ভাড়া নিত। অস্ত্র ভাড়া নিয়ে টেন্ডারবাজি, ছিনতাই ও কিলিং অপারেশনে এসব অস্ত্র ব্যবহৃত হতো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টলা এক্সপ্রেসে করে আনা হতো সম্রাটের ইয়াবার চালান। এ কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করত বহনকারী ছাড়াও ট্রেনের কিছু গার্ড ও নিরাপত্তা কর্মীরা। তাদের জ্ঞাতসারে আসত ইয়াবার চালান। তারপর তা কমলাপুরে পৌঁছলে হাতবদলে গ্রহণ করত সম্রাটের সহযোগী ক্যাডার সাগর। সাগর এসব ইয়াবা তার কাছে ছাড়াও কাকরাইলে যুবলীগের প্রধান কার্যালয়ের ভেতরে থাকা সম্রাটের কক্ষেও রাখত। গত ৬ অক্টোবর র্যাবের অভিযানে তার প্রমাণও মিলেছে। সেদিন যুবলীগের কার্যালয়ে অভিযানের সময় সম্রাটের কক্ষ থেকে হাজারের ওপরে ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছিল। এমন ইয়াবা সম্রাটের কার্যালয়ে সবসময় রাখা হতো বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, সম্রাট ক্যাসিনো ব্যবসা চালুর আগে থেকেই ইয়াবা ব্যবসা করতেন; কিন্তু তা ছিল অত্যন্ত গোপনে। দলের অনেক কর্মীও বিষয়টি জানত না। শুধু তার কাছের লোকজনই জানত। সম্রাটের ক্যাসিনো দেখভালের দায়িত্বে ছিল আরমান আর ইয়াবার দায়িত্বে ছিল সাগর। সম্রাটের ব্যবসা দেখভালের জন্য সাগরকে সহযোগিতা করত তার চাচা টুটুল। খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া গ্রেফতারের পর থেকে তারা পলাতক। গা ঢাকা দিয়েছে। এলাকায় গিয়েও তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, মতিঝিলের ক্লাবপাড়ার প্রতিটি ক্লাবে চলত মদ ও ইয়াবা, যা ছিল ওপেন সিক্রেট। বিষয়টি সবাই জানত; কিন্তু প্রশাসন তেমন কিছু বলত না। কারণ প্রতি মাসেই মাসোহারা পেত থানা পুলিশ। শুধু ক্যাসিনো ও ইয়াবা ব্যবসা থেকেই সম্রাটের আয় হতো না, এসবের পাশাপাশি মতিঝিল এজিবি কলোনির পাশে আইডিয়াল স্কুল ও কলেজের সামনে বসা হলি ডে মার্কেট থেকে প্রতি দোকান বাবদ ৩০০ টাকা তোলা হতো। এর মধ্যে ১০০ টাকা ভাগ পেতেন সম্রাট, ১০০ টাকা খালেদ এবং বাকি ১০০ টাকা কর্মী ও পুলিশের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হতো।
মতিঝিল আওয়ামী লীগের এক নেতা জানান, সম্রাট তার ক্যাসিনো ও ইয়াবা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে মতিঝিল, শাহজাহানপুর ও খিলগাঁও এলাকায় তিনজন যুবলীগের কাউন্সিলর বানিয়েছেন। এটা করেছিলেন নিজের রাজত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে করা হয়েছিল কাউন্সিলর। সম্রাট তার রাজত্ব বজায় রাখতে কোনো ওয়ার্ডেই যুবলীগের নেতাকে বেশি ওপরে উঠতে দিতেন না। কেউ উঠতে চাইলে তাকে নানাভাবে দমিয়ে রাখতেন।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের এক কর্মকর্তা জানান, শাহজাহানপুরের চারটি বস্তি, নয়টি গ্যারেজ ও পাঁচটি ক্লাব থেকে প্রতি মাসে কোটি টাকার ওপরে চাঁদা তোলা হতো। এই টাকা যুবলীগের খালেদের কথা বলে প্রকাশ্যে তুলত তার লোকজন। খালেদ কমলাপুর স্টেশনে গেলে তাকে ভিআইপি প্রটোকল দেওয়া হতো, যা সাধারণত এমপিরা পেয়ে থাকেন। কিন্তু খালেদ কোনো জনপ্রতিনিধি না হয়েও তা পেতেন। আর সেটা করতেন কমলাপুর স্টেশনের কিছু কর্মকর্তা। এই স্টেশনে সম্রাটের ইয়াবা আসার জন্য স্টেশনের কয়েকজন কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্য সাহায্য করত। এর বিনিময়ে তারা প্রতি মাসে মাসোহারা পেত। বেশিরভাগ ইয়াবা আসত চট্টলা এক্সপ্রেস ট্রেনে। এ কারণে গত কয়েক বছরে তেমন ইয়াবার চালান ধরা পড়েনি কমলাপুর স্টেশনে। খালেদ ও সম্রাটকে নানাভাবে সহযোগিতা করত জিআরপির সাবেক ওসি ইয়াসিন ফারুক। অন্যদিকে মতিঝিলপাড়ার ক্লাবগুলোতে ইয়াবা ও মদ চালানোর জন্য মতিঝিলের সাবেক ওসিরও সমর্থন পেত সাগর।