ঢাকা বুধবার, ৭ই মে ২০২৫, ২৫শে বৈশাখ ১৪৩২


মুক্তিযোদ্ধাকে পিটিয়ে যুবলীগের পদ হারিয়েছিলেন রাজীব


২২ অক্টোবর ২০১৯ ০০:৩৭

আপডেট:
৭ মে ২০২৫ ২২:৪১

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর যুবলীগ নেতা তারেকুজ্জামান রাজীবকে গ্রেফতারের পর তার সম্পর্কে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। তার অপরাধ জগত নিয়ে উঠে আসছে নানা অভিযোগ। এতদিন ভয়ে যারা টু শব্দটি করার সাহস করেননি তারা রাজীবের গ্রেফতারের পর নির্ভয়ে কথা বলছেন।


এলাকাবাসী যুগান্তরকে জানান, ফুটপাতের সামান্য টং দোকানদার ছিলেন রাজীব। সাবেক এক প্রতিমন্ত্রীর হাত ধরে মোহাম্মদপুরে যুবলীগের মাধ্যমে রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা ফাহিমকে পিটিয়ে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই তিনি যুবলীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন।

এ জন্য যুবলীগের কেন্দ্রীয় এক নেতাকে এক কোটি ২০ লাখ টাকা দিতে হয়েছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতা পদ পেতে রাজীবের জন্য যুবলীগ চেয়ারম্যানকে একটি ডিও লেটারও দিয়েছেন।

গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তাকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়া হয়নি। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি সাবেক এক প্রতিমন্ত্রীর আশীর্বাদে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এর পর থেকেই মূলত তার ভাগ্য খুলে যায়।

যুবলীগের সাইনবোর্ড আর কাউন্সিলরের পদ ব্যবহার করে এলাকায় সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলেন তিনি। তার বাহিনীর সদস্যরাই এলাকায় কিশোর গ্যাং, মাদক ও ডিশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। মোহাম্মদপুরে যুবলীগ কর্মী তসির উদ্দিন হত্যা মামলার আসামিরাও তারই ঘনিষ্ঠ।

স্থানীয় ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন বলেন, কাউন্সিলর হওয়ার পর এমন কোনো অপকর্ম নেই যা রাজীব করেনি। তার হয়ে যারা চাঁদা আদায় করে তাদের মধ্যে আছে- অভি ফারুক, শাহ আলম, সিএনজি কামাল, ইসরাফিল লাবু প্রমুখ।

তারা ফুটপাত থেকেই প্রতিদিন ৪০-৫০ হাজার টাকা আদায় করছে বলে জামাল উদ্দিন জানান।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন ফুটপাত, বেড়িবাঁধ, বাসস্ট্যান্ড, সিএনজি স্ট্যান্ড, চন্দ্রিমা হাউজিং, সাতমসজিদ হাউজিং, ঢাকা উদ্যানসহ বিভিন্ন এলাকায় দখলবাজি ও চাঁদাবাজিই তার অবৈধ সম্পদের মূল উৎসব।

তার বিরুদ্ধে প্রবাসীদের বাসাসহ এলাকার অনেকের জমি দখলের অভিযোগও রয়েছে।

মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির ১ নম্বর রোডে তার যে বিলাসবহুল বাড়ি আছে তার বেশিরভাগ জায়গা সরকারি। পানির পাম্পের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গা দখল করে তিনি বাড়ি বানান।

চাঁন মিয়া হাউজিংয়ের সেখানে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিস সেটির মালিকানা জেলা প্রশাসনের। রাজীব তার বাবা এবং স্ত্রীর নামে অনেক সম্পদ করেছেন বলে অভিযানে থাকা একজন র‌্যাব সদস্য জানান।

র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম জানান, মোহাম্মদীয়া হাউজিংয়ের ১ নম্বর রোডে রাজীবের যে বাড়িটি রয়েছে সেটি খুবই রাজকীয়।

এ বাড়িটির বাজারমূল্য ১০ কোটি টাকার বেশি। বাড়ির আসবাবপত্র থেকে শুরু করে প্রতিটা জিনিস তিনি বিদেশ থেকে আমদানি করেছেন।

এটি তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বলেই ধারণা করা হচ্ছে। কাউন্সিলর হওয়ার আগ পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো ধরনের ব্যবসা বা পেশা ছিল না। সিটি কর্পোরেশন থেকে যে সম্মানী পায়, সেটিই তার বৈধ আয়। এ ছাড়া বাকি সব অবৈধ লেনদেন।

র‌্যাব কর্মকর্তা সারওয়ার আলম বলেন, কাউন্সিলর হওয়ার পরপরই রাজীব ২০১৬ সালে তিনটি কোম্পানি খুলেছেন। এগুলো হল- সিলিকন, এক্কা এবং নাইমা এন্টারপ্রাইজ। দুঃখজনক হলেও এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের আড়ালে তিনি জমি দখল করেছেন।

কিছু কিছু জায়গায় লোকজনকে অত্যন্ত কম মূল্যে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করেছেন। অপকর্ম করতে গিয়ে রাজীব আত্মীয় ও অনাত্মীয় যেসব লোকজনকে ব্যবহার করেছেন, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

যে জায়গাটিতে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের অফিস সেটি জেলা প্রশাসনের বলে আমরা জানতে পেরেছি। তবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনও কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তিনি বলেন, চলমান শুদ্ধি অভিযানের মুখে গত ১৩ অক্টোবর থেকে আত্মগোপনে ছিলেন রাজীব।

কাউন্সিলর অফিসে অভিযানের সময় রাজীবের বড় ভাই আখতারুজ্জামান রাসেল সাংবাদিকদের বলেন, ওর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে, তা মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। অল্প বয়স থেকে সে রাজনীতিতে জড়িত।

এলাকার মানুষ জানে সে কত জনপ্রিয়। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সে নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। এখন তাকে মিথ্যাভাবে ফাঁসানো হচ্ছে।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবের কোটি টাকার অবৈধ লেনদেনের তথ্য পেয়েছে র‌্যাব। গত ২৬ আগস্ট ব্র্যাক ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্টেই তিনি জমা দিয়েছেন ৫ কোটি টাকা।

৩টি চেকে ওই টাকা জমা দেয়া হয়। দুটি চেকে এক কোটি করে এবং একটি চেকে ৩ কোটি টাকা জমা দেয়া হয়।

গ্রেফতারের পর র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে রাজীব নিজেই তার অবৈধ লেনদেন, দখলদারিত্ব এবং অপরাধ জগতের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য দিয়েছেন।

এতদিন ভুক্তভোগীরা তার ভয়ে কথা বলার সাহস পাননি। এখন তাদের অনেকেই তার নানা অপকর্ম তুলে ধরছেন। রোববার তার ফাঁসির দাবিতে এলাকাবাসী বিক্ষোভ করেছেন।

এদিকে এদিন রাত সাড়ে ৯টায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-১-এর ডিএডি মিজানুর রহমান বাদী হয়ে ভাটারা থানায় কাউন্সিলর রাজীবের বিরুদ্ধে অস্ত্র এবং মাদক আইনে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন।

এরপর তাকে প্রত্যেক মামলায় ১০ দিন করে রিমান্ড চেয়ে রাতেই ঢাকা মহানগর হাকিম ইয়াসমিন আরার আদালতে হাজির করে পুলিশ। শুনানি শেষে রাত ১২টা ১০ মিনিটে আদালত দুই মামলায় ৭ দিন করে ১৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

শনিবার রাতে সন্ত্রাসী কার্যক্রম, চাঁদাবাজি এবং দখলদারিত্বের অভিযোগে ভাটারার একটি আবাসিক এলাকার বাসা থেকে রাজীবকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এ সময় একটি পিস্তল, তিন রাউন্ড গুলি, সাত বোতল বিদেশি মদ ও নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়।

ওই বাসাটি রাজীবের বন্ধু মিশুর। মিশু যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। তার গাড়ির ব্যবসা আছে। রাজীবকে নিত্যনতুন মডেলের গাড়ি মিশুই সরবরাহ করতেন।

রাত সোয়া ১টার পর বন্ধুর বাসা থেকে রাজীবকে নিয়ে র‌্যাব সদস্যরা তার মোহাম্মদপুরের বাসা ও অফিসের উদ্দেশে রওনা হন। রাত ২টার দিকে তারা মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির বাসায় পৌঁছান।

তখনও বাসার সামনে উৎসুক জনতার ভিড় ছিল। রাজীব গ্রেফতারে তাদের অনেকেই সন্তোষ প্রকাশ করেন।

এই বাসায় প্রায় ২ ঘণ্টা অভিযান চলে। এরপর ভোর ৪টার দিকে কাউন্সিলরকে সঙ্গে নিয়ে মোহাম্মদপুরের চানমিয়া হাউজিংয়ে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে যান র‌্যাব সদস্যরা।

সেখানে অভিযানের সময় সহযোগিতা না করা এবং আলামত নষ্ট করার অভিযোগে অফিস সহকারী সাদেক আহমেদকে ভ্রাম্যমাণ আদালত তিন মাসের কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছেন।