রাজউক গণপূর্ত গৃহায়ন শিক্ষায় মোল্লা কাওছার ছিলেন সব

স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মোল্লা মো. আবু কাওছার। নিজেকে একজন আইনজীবী হিসাবে দাবি করলেও এ পেশায় তার সক্রিয়তা নেই। তিনি স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করতেন। দুই পদকে ব্যবহার করে সম্পন্ন করেছেন নানা অপকর্ম। কাওছারকে গতকাল ক্যাসিনো কান্ড দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তার বহিষ্কারের পর বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে নানা অপকর্ম, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজির কথা।
রাজধানীর গণপূর্ত, রাজউক, শিক্ষা ভবন ও গৃহায়নে ছিল তার একচ্ছত্র আধিপত্য। এই চার দফতরে তার অনুমতি ছাড়া কোনো ঠিকাদার টেন্ডার ড্রপ করতে পারতেন না। সরকারি কোনো প্রকল্পের কাজ তার প্রতিষ্ঠান ও লোকদের বাইরে কেউই পেত না। কাজ পেলেই তাকে দিতে হতো কাজের ভাগ হিসেবে টাকা। এই মানুষটি ১০ বছর আগেও অস্বচ্ছল ছিলেন, তিনি এখন চলেন দামি গাড়িতে, থাকেন বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে। আইন পেশায় না থাকলেও তার প্রতি মাসে আয় কয়েক লাখ টাকা। বিষয়টি দলের অনেকের কাছে বিস্ময়ের বিষয়। কিন্তু দলের নেতা হওয়ায় এতদিন তারা মুখ খোলেননি বলে জানা গেছে।
রাজউক, গণপূর্ত, গৃহায়ন ও শিক্ষা ভবনে বিশাল সিন্ডিকেট : মোল্লা মো. আবু কাওছার ঠিকাদার নন, একজন রাজনৈতিক নেতা। তবে তার একটি নামমাত্র ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে জানা গেছে। কখনও নিজের প্রতিষ্ঠানের নামে, আবার কখনও অন্য প্রতিষ্ঠানের নামে তিনি কাজ নিতেন। যার কারণে গণপূর্ত, রাজউক গৃহায়ন ও শিক্ষা ভবনে ছিল তার বিশাল সিন্ডিকেট। গ্রেফতার হওয়া জিকে শামীম, যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূইয়া ও সম্রাট ছাড়াও দুই সিটির মাধ্যমে স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দিয়ে সব কিছু করাতেন এই নেতা।
এই চার দফতরের কর্মচারীরা ছিল তার হাতের মুঠোয়। কোনো কাজের প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেই তা তাকে ফোনে জানানো হতো এবং এমনকি কারা কারা টেন্ডার ড্রপ করছে তারও খবর পেতেন এই কাওছার। সব কিছু করা হতো দফতরগুলোর উচ্চ পর্যায়ে থাকা কর্মকর্তাদের যোগসাজসে। তবে এসব তথ্য দেওয়ার জন্য ওই কর্মকর্তারা তার কাছে মোটা অঙ্কের টাকাও পেতেন। কাওছার যে রাজউক, গণপূর্ত, শিক্ষা ভবন ও গৃহায়নের সব ছিলেন বিষয়টি অনেকের কাছে ছিল ওপেন সিক্রেট। কিন্তু অনেকে চাকরির ভয়ে কথা বলতে সাহস পেতেন না।
স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ও ঠিকাদারদের অনেকে জানিয়েছেন, কাওছারের এই চার দফতরে টেন্ডারবাজির সবটাই নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার অনুমতি ছাড়া কোনো ঠিকাদার টেন্ডার ড্রপ করতে পারতেন না।
কাজ নিয়ে বিক্রি করতেন কাওছার : মোল্লা আবু কাওছার বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নিলেও কাজ করতেন না। চার দফতরে থাকা কর্মকর্তাদের যোগসাজসে তিনি সব কাজ পেতেন। পরে সেই কাজের বাজেটকে তিন ভাগ করতেন। এক বা অর্ধেক তাকে দিতে হবে শর্তে পুরো কাজ বিক্রি করতেন। জিকে শামীম, খালেদ ভূইয়া ও এমপি শাওনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নানা শর্তে কাজ দিতেন। যার কাছে বেশি কমিশন পেতেন তাকেই কাজটি দিতেন। কাওছার কাজের টেন্ডার ড্রপ করলে অন্য কেউ আর টেন্ডার ফেলার সাহস পেতেন না।
তবে প্রতিটি কাজই তিনি বিক্রি করতেন। সর্বশেষ অস্ত্র ও মানি লন্ডারিং আইনের মামলায় রিমান্ড শুনানির জন্য ২ অক্টোবর দ্বিতীয় দফায় আদালতে নেওয়া হয়েছিল জিকে শামীমকে। ওই সময় আদালতে মোল্লা কাওছারের খোঁজ করেন তিনি। শামীম তার আইনজীবীদের কাছে জিজ্ঞেস করেন, মোল্লা কাওছার কোথায়? সে আসে নাই? ওই সময় একজন উত্তর দেন, ‘উনি তো নিজেই দৌড়ের ওপরে আছেন। উনি কী করে আসবেন! জিকে শামীমের সঙ্গে মোল্লা আবু কাওছারের কি ধরনের সম্পর্ক ছিল এ থেকেই অনেকটা অনুমান করা যায়। তবে অনেকে জানিয়েছে, জিকে শামীমকে তিনি সব কাজ দিতেন বলে তাকে বড়ভাই হিসেবে মানতেন শামীম।
ওয়ান্ডারার্সে চলা ক্যাসিনোর অংশীদার : মতিঝিলের আরামবাগে থাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে নিয়মিত ক্যাসিনো, মদ ও জুয়ার আসর বসত। প্রায় কয়েক বছর ধরেই চলত এসব কাজ। এই ক্লাবের সভাপতি হওয়ায় প্রতি মাসে একটি মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়া হতো কাওছারকে। ক্লাবের ক্যাসিনো ব্যবসায় যে কজন অংশীদার তাদের মধ্যে মোল্লা আবু কাওছার ছিলেন অন্যতম।
মতিঝিলের এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ক্লাবটিতে ক্যাসিনো ব্যবসার চালানোর ব্যাপারে প্রত্যক্ষ মদদ ছিল কাওছারের। এ নিয়ে দলের অনেকের সঙ্গে মনোমালিন্যও হয়। সে কারও কথাই শুনত না। সম্রাট, খালেদ ও আরমানকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাসিনো ব্যবসা চালাতেন কাওছার। তবে ক্লাবটিতে এসব অপকর্ম চালানোর জন্য পুলিশ প্রশাসনকে নিয়মিত বখরা দিতেন তিনি। যার কারণে পুলিশও তেমন সমস্যা করত না। মতিঝিল থানার সাবেক ওসি ওমর ফারুক ও পল্টন থানার ওসি মাহমুদুল হাসানও ক্যাসিনোগুলো থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেতেন। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে অভিযানের পর ক্লাবটিতে মালিকানা হিসেবে মোল্লা মো. আবু কাওছারের নাম উঠে আসে।
মূলত তার ঘনিষ্ঠরাই ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত ছিল। তবে সম্প্রতি সভাপতি হলেও মালিকানার অভিযোগ অস্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে স্বেচ্ছাসেবক লীগ। ২০১৫ সালে কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর আরামবাগের ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ক্যাসিনো চালু করেন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুল হক ওরফে সাঈদ। তার আগে থেকেই এ ক্লাবের সভাপতির দায়িত্বে আছেন মোল্লা মো. আবু কাওছার।
নামে মাত্র আইনজীবী : ঢাকার একটি কলেজ থেকে ল’ পাস করেন মোল্লা আবু কাওছার। আইন পাস করলেও তিনি কখনই এ পেশায় যুক্ত ছিলেন না বলে জানা গেছে। তবে মাঝে মাঝে হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টে ঢুঁ মারতেন। স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা বলেন, উনি তো নামেই একজন আইনজীবী। আইন পেশা তার স্রেফ সাইনবোর্ড।
ক্যাসিনো কান্ডে গ্রেফতারকৃত যুবলীগের নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, খালেদ মাহমদু ভূইয়া ও ঠিকাদার জিকে শামীমকে জিজ্ঞাসাবাদে তার নাম আসে। তারা জিজ্ঞাসাবাদে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্র, আবাহনী ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স ক্লাবসহ বিভিন্ন ক্লাবের জুয়া ও ক্যাসিনোর টাকা পেতেন এই মোল্লা আবু কাওছার। আবু কাওছার ছিলেন ক্যাসিনো ব্যবসার অন্যতম চাঁদাবাজ। প্রতিটি ক্লাবের ক্যাসিনো চললেই তাকে তার ভাগ দেওয়া হতো। যেসব ক্লাবে ক্যাসিনো চলত তার প্রত্যেকটি থেকে সাপ্তাহিক ও দৈনিক ভিত্তিকে একটি চাঁদা বিভিন্ন জনের পকেটে যেত। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এই মোল্লা আবু কাওছার।
৭ বছর ধরেই একই পদে তিনি : মোল্লা আবু কাওছার ১০ বছর আগেও ছিলেন একজন অতি সরল সাধারণ মানুষ। কিন্তু এখন তিনি দলের নেতাকর্মীদের কাছে অনেক কিছু। তার কথাতেই দলে সব হয়। দলের সভাপতির পদটি টানা সাত বছর ধরে জোর করে আঁকড়ে ধরে আছেন এই নেতা। কাউন্সিলের সময় তিন বছর আগে পেরিয়ে গেলেও এখনও কাউন্সিল দেননি। এ নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মাঝে রয়েছে নানা ক্ষোভ।
অনেকে বলেছেন, সভাপতির পদ না ছাড়তেই তিনি কাউন্সিল দিচ্ছেন না। দলের নাম ভাঙিয়ে অনেক কিছু করলেও স্বেচ্ছাসেবক দলের কাজটা কি তা অপরিষ্কার ছিল নেতাদের কাছে। তবে মোল্লা আবু কাওছার দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও এ বিষয়ে গণমাধ্যমে তেমন কোনো কথা বলেননি।