৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি: এবার ফাঁসতে পারেন বাচ্চু

বেসিক ব্যাংকের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির সময় চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা আবদুল হাই বাচ্চু এবার ফেঁসে যেতে পারেন। ব্যাংকটির ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় বাচ্চুর সম্পৃক্ততার তথ্য-প্রমাণ নতুন করে সংগ্রহের কাজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে তথ্য চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকের কাছে দুদক থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে। ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হলে নতুন করে আলোচনায় আসেন বাচ্চু।
২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে লোপাটের ঘটনা ঘটে। চার বছর অনুসন্ধানের পর দুদক ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকের ২৬ জন কর্মকর্তাসহ ১৫৬ জনের বিরুদ্ধে ৫৬টি মামলা করে। কিন্তু ওই সময়ে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু বা পরিচালনা পর্ষদের অন্য কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেনি দুদক। বেসিক ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় বাচ্চুর সম্পৃক্ত থাকার বিষয়ে তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদেও বক্তব্য রাখেন। তবে দুদক বলছে, এখনো বাচ্চুর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের প্রমাণ পায়নি তারা। ২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয় সরকার। ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠলে ২০১৪ সালে চাপের মুখে পদত্যাগ করেন বাচ্চু।
বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার পর গ্রেপ্তার না হওয়া বাচ্চু বিভিন্ন সময়ই সংসদের ভেতরে ও বাইরে আলোচিত হয়েছেন। চলমান শুদ্ধি অভিযানের সময় রাজধানীর ধানম-ি এলাকার আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির মূল ব্যক্তি ব্যাংকটির তখনকার চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু। সে কারণে তাকে ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে অপসারণও করা হয়েছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে দুদক কোনো মামলা করেনি, এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থাও নেয়নি। তিনি বলেন, ‘দুদক চেয়ারম্যান যদি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন তাহলে তার পদত্যাগ করা উচিত।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, চলমান অভিযান শুরুর পর থেকে বাচ্চুর বিষয়ে অধিকতর তদন্তের জন্য তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহে নেমেছে দুদক। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে চিঠি পাঠিয়ে ব্যাংকটির ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনার সঙ্গে বাচ্চুর সম্পৃক্ততার বিষয়ে নতুন করে তথ্য চাওয়া হয়েছে। বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুদকের করা ৫৬ মামলার চার্জশিট দেওয়ার আগেই তার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে অধিকতর তদন্তে যাচ্ছে দুদক। এরই অংশ হিসেবে বাচ্চুর সম্পৃক্ততার বিষয়ে তথ্য চেয়েছে তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের সচিব মুহম্মদ দিলোয়ার বখ্ত গতকাল বলেন, এ ব্যাপারে কোনো কিছু বলার থাকলে আপনাদের ডাকা হবে। এখন কিছু বলব না।
জানা গেছে, বেসিক ব্যাংকের তখনকার চেয়ারম্যান বাচ্চুকে বাদ রেখেই ৫৬ মামলার চার্জশিট প্রায় চূড়ান্ত করা হচ্ছিল। কমিশনের অনুমোদনের পর চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হবে। এসব মামলায় দেড় শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হচ্ছে। এর মধ্যে অন্তত ২৫ জন ব্যাংক কর্মকর্তা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ করা ৫৪ প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১৩০ জন ব্যক্তির নাম রয়েছে। এর মধ্যে আবদুল হাই বাচ্চু কিংবা ওই সময় পরিচালনা পর্ষদে থাকা কারও নাম নেই। তবে তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামের নাম আছে।
জানতে চাইলে বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি মামলার তদন্ত দলের প্রধান দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বলেন, ৫৬ মামলার তদন্তকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এখনো কিছু কাজ চলছে। কম সময়ের মধ্যে অগ্রগতি দেখা যাবে।
দুদকের অন্য পরিচালক মীর মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন শিবলী বলেন, অল্প সময়ের মধ্যেই কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে চার্জশিট আদালতে পাঠানো হবে।
২০১১ সালে বেসিক ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় অনিয়ম করে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ পায় দুদক। অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রায় চার বছরের অনুসন্ধান শেষে ২০১৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর পল্টন, মতিঝিল ও গুলশান থানায় ৫৬টি মামলা করে দুদকের তদন্ত দল। কোনো মামলাতেই ব্যাংকটির ওই সময়কার পরিচালনা পর্যদের চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুসহ পরিচালনা পর্যদের অধিকাংশ সদস্যকে আসামি করা হয়নি। এই ৫৬ মামলাগুলোয় মোট ২ হাজার ৯ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। পরে আরও বেশ কয়েকটি মামলা করে দুদক।
তদন্ত দলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫৬ মামলার মধ্যে বেশকিছু চার্জশিট অনুমোদনের জন্য কমিশনে পাঠানো হয়েছে। যার কোনোটিতেই বাচ্চুসহ পরিচালনা পর্যদের সদস্যদের নাম নেই। শুধু পদাধিকার বলে পরিচালনা পর্যদের সদস্য তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামের নাম রয়েছে।
ওই সময় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্যদে ছিলেন শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর নেতৃত্বে আটজন। তারা হলেন পদাধিকারবলে সদস্য ছিলেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বর্তমানে পলাতক কাজী ফখরুল ইসলাম, তৎকালীন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান শুভাশীষ বোস, তৎকালীন বিসিকের চেয়ারম্যান ও বর্তমানে সিনিয়র সচিব শ্যামসুন্দর সিকদার, নিলুফার আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক কামরুন্নাহার আহমেদ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা মো. আনোয়ারুল ইসলাম (এফসিএমএ) এবং মাসিক ‘উত্তরণ’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক আনিস আহমেদ। অধিকাংশ ঋণ মঞ্জুরিতেই তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের স্বাক্ষর রয়েছে।