ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ৮ই মে ২০২৫, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩২


কাউন্সিলর হয়েই বেপরোয়া, সবুজবাগজুড়ে ফরিদের থাবা


৬ নভেম্বর ২০১৯ ২২:৪৬

আপডেট:
৮ মে ২০২৫ ১৮:২৪

          *অভিযোগের শেষ নেই

          *অবৈধভাবে জমি দখল

          *ভাগ্নে শাওনকে দিয়ে মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ

          *ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের কোণঠাসা

          *অবৈধ অনুপ্রবেশকারী

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আশ্রাফুজ্জামান ফরিদের বিরুদ্ধে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগের শেষ নেই। অবৈধভাবে জমি দখল, ভাগ্নে শাওনকে দিয়ে মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ, সরকারি জমিতে বাজার বসিয়ে টাকা কামানো, কমিউনিটি সার্ভিসের নামে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়, বিএনপির স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে এলাকার ডিশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ এবং সিএনজি স্টেশন থেকে মাসিক ভিত্তিতে চাঁদা আদায়সহ তার অপকর্মের যেন শেষ নেই। এ ছাড়া সবুজবাগ এলাকায় কোনো আবাসন ব্যবসায়ী নতুন ভবন নির্মাণ করতে গেলেও কাউন্সিলর ফরিদকে দিতে হয় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ।

এদিকে ডিএসসিসির এই কাউন্সিলর সবুজবাগ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে সংগঠনের 

করে রেখেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এলাকাবাসীর ভাষ্য, কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ফরিদ এলাকার উন্নয়নে তেমন কোনো ভ‚মিকাই রাখছেন না। ডিএসসিসির ২০টি বোর্ডসভার মধ্যে ১০টিতেই অনুপস্থিত ছিলেন তিনি। বোর্ডসভায় অনুপস্থিত থাকায় গত ২৭ অক্টোবর তাকে     কারণ দর্শানোর নোটিসও দিয়েছে ডিএসসিসি।

র অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে সুবজবাগ থানা আওয়ামী লীগের রাজনীতি দুটি ভাগে বিভক্ত। এর মধ্যে একটি পক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন কাউন্সিলর ও থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আশ্রাফুজ্জামান ফরিদ। আরেকটি পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লায়ন চিত্তরঞ্জন দাস।

এলাকাবাসী জানায়, কাউন্সিলর ফরিদের হয়ে এলাকায় মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ করে তার ভাগ্নে শাওন। আর এ কাজের জন্য শাওনের রয়েছে একটি নিজস্ব বাহিনী। তারা পুরো এলাকায় বিভিন্ন মাদকদ্রব্য সরবরাহ করে থাকে। মাদক কারবার শুরুর আগে ফরিদের ভাই মুরাদ মুন্সি ও ভাগ্নে শাওন অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায় জড়িত ছিল।

 

কয়েক মাস আগে সবুজবাগ থানার একটি মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বেশ কিছুদিন কারাগারে ছিল শাওন। ভাগ্নে শাওন ছাড়াও ফরিদের হয়ে এলাকায় নানা অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার আহমেদ পাপ্পুর বিরুদ্ধে। ফরিদের অপকর্মের অন্যতম সহযোগী হিসেবে আলোচিত আরেকজন হলেন ফ্রিডম পার্টির সাবেক নেতা মজিবুর রহমান।

২০১৩ সালে ফরিদের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ক্রমেই প্রভাবশালী হয়ে ওঠা মজিবুরও সরকারি জমি দখলের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া কাউন্সিলর ফরিদের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত সবুজবাগ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন দক্ষিণ রাজারবাগ এলাকায় ‘জনকল্যাণ সমিতি’র আড়াই কাঠা জমি দখলের পর সেখানে গড়ে তুলেছেন একটি ভবন।

ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে গ্রেপ্তার হওয়া যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভ‚ঁইয়ার লোক হিসেবে পরিচিত সবুজবাগের যুবলীগ নেতা আমীর হোসেনও কাউন্সিলর ফরিদের হয়ে এলাকায় নানা অপকর্ম করে যাচ্ছেন। কাউন্সিলরের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত যুবলীগ নেতা ছোট পিয়াস ৯ নম্বর ওয়াসা রোড এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে মাদকের কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা জানান, ফরিদ কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় যারা এলাকার ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত তাদেরই সেই কাজে বহাল রেখেছেন। এর মধ্যে আহম্মদবাগ এলাকায় বিএনপি নেতা মতিন ও বিল্লাল, সবুজবাগ এলাকায় যুবদল নেতা চয়ন, মায়াকানন এলাকায় ৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাধারণ সম্পাদক বাবু, বাসাবো এলাকায় বিএনপি নেতা আব্দুর রহিম এবং মাদারটেক এলাকায় হারুন এসব ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। আর এই খাত থেকে প্রতি মাসে ফরিদের হাতে আসে তিন লাখ টাকারও বেশি।

এলাকায় যেকোনো আবাসন কোম্পানি নতুন ভবন নির্মাণ করতে গেলেও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিতে হয় ফরিদকে। কমলাপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর ফরিদ। সেখানেও নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ অবসরে গেলে কদমতলী কারিগরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের কারিগরি বিষয়ের শিক্ষক বশির আহমেদকে সেখানে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেন ফরিদ। বিনিময়ে ওই শিক্ষকের কাছ থেকে নেন মোটা অঙ্কের অর্থ। পরে অবশ্য নানা মহল থেকে ব্যাপক আপত্তির মুখে এ নিয়োগ বাতিল হয়ে যায়।

অভিযোগ রয়েছে, এলাকার বাসাবাড়িতে নতুন করে পানি বা গ্যাসের সংযোগ নিতে গেলেও অর্থ দিতে হয় কাউন্সিলর ফরিদ মনোনীত প্রতিনিধিকে। আর এ কাজে এলাকায় ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত অলি ও আজিজসহ কয়েকজনকে কাজে লাগান তিনি।

এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, সবুজবাগ এলাকা থেকে যেসব লেগুনা ও টেম্পো রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচল করে তার সবকটি থেকেই নিয়মিত টাকা আদায় করেন কাউন্সিলর ফরিদ। বাসাবো বৌদ্ধমন্দির থেকে রাজারবাগ কালীমন্দির পর্যন্ত চলাচলকারী লেগুনা থেকে তিনি প্রতিমাসে চাঁদা হিসেবে পান কয়েক লাখ টাকা। এ ছাড়া মায়াকানন, সবুজবাগ, উত্তর মুগদাপাড়া ডেপুটি কলোনি, আহম্মদবাগ, রাজারবাগ উত্তর ও দক্ষিণ, কদমতলা বাসাবো ও পূর্ব বাসাবো এলাকার সড়কে চলাচলকারী টেম্পো, সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা এবং ইঞ্জিনচালিত রিকশা থেকেও কাউন্সিলরের পক্ষে চাঁদা আদায় করেন মোমিন, আব্দুল্লাহ, সেন্টু ও মমিন নামে চার ব্যক্তি। তারা টাকা তুলে পৌঁছে দেন কাউন্সিলরের কাছে।

যেভাবে উত্থান কাউন্সিল ফরিদের : এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, ১৯৮০ সালের দিকে বরিশাল থেকে ঢাকায় বসবাসের জন্য আসেন আশ্রাফুজ্জামান ফরিদ। শুরুতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষে এলাকায় ব্যানার-পোস্টার লাগানোর কাজ করে সামান্য যে টাকা পেতেন তাই দিয়ে সংসার চালাতেন।

পরে ২০০২ সালে সাবেক ২৮ নম্বর ওয়ার্ড (বর্তমান ৫ নম্বর ওয়ার্ড) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন তিনি। এরপর ২০১৬ সালে সবুজবাগ থানা আওয়ামী লীগ সভাপতির পদ বাগিয় নেন ফরিদ। বর্তমানে বাসাবোর ৩৮/৮ নম্বর হোল্ডিয়ের ‘মায়া কানন’ নামে একটি ভবনে বসবাস করেন। এ বাড়িটি মিরপুরের রূপনগর থানা জামায়াতের আমির মতিউর রহমানের মালিকানাধীন ছিল। রাজনৈতিক পটপরির্বতনের সঙ্গে সঙ্গে নানা কৌশলে বাড়িটির দখল করে নিজের কব্জায় নিয়ে নেন ফরিদ।

মাদারটেক মাজার গলিতে পাঁচ কাঠার প্লট ও দক্ষিণ বনশ্রীতে একটি ডোবা দখল করে ১৭ কাঠার প্লট এবং দক্ষিণগাঁও, মানিকদিয়া ও রাজারবাগ এলাকায়ও একাধিক প্লট রয়েছে তার। এ ছাড়া সবুজবাগ বৌদ্ধমন্দির প্রধান সড়কে ১২ কাঠার একটি প্লট দখল করে হাতেম তাই নামে একটি রেস্টুরেন্ট চালু করেছেন তিনি। এটি পরিচালনা করেন ফরিদের ভাগ্নে পিটার।

এদিকে তার বিরুদ্ধে ওঠা বিস্তর অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে কাউন্সিলর আশ্রাফুজ্জামান ফরিদের ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।