অসদাচরণের দায়ে তুরিন আফরোজকে অপসারণ

মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার এক আসামির সঙ্গে গোপন বৈঠকের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর পদ থেকে তুরিন আফরোজকে অপসারণ করেছে সরকার। আইন ও বিচার বিভাগের সলিসিটর অনুবিভাগ থেকে সোমবার জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘শৃঙ্খলা ও পেশাগত আচরণ ভঙ্গ এবং গুরুতর অসদাচরণের দায়ে’ প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে।
এই অভিযোগে গত বছরের মে মাসেই তুরিন আফরোজকে ট্রাইব্যুনালের সব মামলা পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে সোমবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘একজন আসামির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার অভিযোগ ছিল তার (তুরিন) বিরুদ্ধে। ওই মামলাটি তিনি নিজে পরিচালনা করছিলেন। আসামির সঙ্গে আলাপ-আলোচনার রেকর্ডটি চিফ প্রসিকিউটরের কাছে পাঠানো হয়। রেকর্ডটি আমরাও যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণ করেছি। এ কাজ করতে গিয়ে তার সঙ্গে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু কথা বলেছি। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই তাকে এই পদ থেকে অপসারণ করেছি। তাকে অপসারণ করা জরুরি হয়ে পড়েছিল।’ সোমবার সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মন্ত্রী এসব কথা বলেন।
জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও পাসপোর্ট অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মুহাম্মদ ওয়াহিদুল হকের বিরুদ্ধে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ। গত বছরের এপ্রিলে অভিযোগ ওঠে, মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর ২০১৭ সালের নভেম্বরে ওয়াহিদুল হককে ফোন করে কথা বলেন তুরিন। পরে পরিচয় গোপন করে ঢাকার একটি হোটেলে তার সঙ্গে দেখাও করেন। ওই অভিযোগ ওঠার পর প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ওয়াহিদুল ও তুরিনের কথোপকথনের রেকর্ড ও বৈঠকের অডিও রেকর্ডসহ যাবতীয় ‘তথ্য-প্রমাণ’ আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনালের সব মামলা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় তুরিনকে। তুরিন সে সময় অভিযোগের বিষয়ে সরাসরি কোনো জবাব দেননি। এক ফেসবুক পোস্টে নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও ওই গোপন বৈঠকের কথা তিনি অস্বীকার করেননি।
তুরিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সিনিয়র সমন্বয়ক সানাউল হক বলেছিলেন, ‘ওয়াহিদুল হককে গ্রেফতার করার সময় গুলশান থানার ওসি তার মোবাইল ফোন জব্দ করেছিলেন। ওই মোবাইলে কথোপকথনের দুটি রেকর্ড ছিল। একটি কথোপকথন হয়েছে টেলিফোনে। সেখানে তুরিন আফরোজ আসামি মোহাম্মদ ওয়াহিদুল হককে দাওয়াত দিয়েছেন। ফোনটা তুরিনই করেছিলেন। অন্য রেকর্ডটি ছিল ২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের। এই কথোপকথনে মামলা সংক্রান্ত অনেক কথা রয়েছে এবং মামলার ডকুমেন্ট হস্তান্তরের কথোপকথন রয়েছে। ওসি এটা পাওয়ার পর তিনি মনে করলেন, আমাদের জানানো দরকার। আমরা এটা হাতে পাওয়ার পর প্রসিকিউশনকে দিয়েছি।’তুরিন আফরোজের অপসারণ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী সোমবার বলেন, অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে প্রসিকিউটরের পদ থেকে অপসারণ করেছি।’ তিনি বলেন, ‘আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি তার কাজে আমরা সন্তুষ্ট। অপসারণ হওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত তাকে আমরা যে দায়িত্ব দিয়েছি সেই দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে গেছেন। কিন্তু তিনি কেন যে ওই কাজটি করতে গেলেন, এটা দুঃখজনক। আমরা যে তাকে খুশিমনে অপসারণ করেছি তা কিন্তু নয়। যে মামলা নিয়ে আসামির সঙ্গে তিনি কথা বলেছিলেন সেই মামলার চার্জ এখন গঠন করা হচ্ছে। এজন্য ওই পদ থেকে তাকে অপসারণ করেছি। প্রসিকিউটর জিয়াদ আল মালুম বলেছিলেন, তুরিন আফরোজ ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। তার বিরুদ্ধে আইন মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে। এখন মন্ত্রণালয় কি তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে কিনা জানতে চাইলে ‘কোনো মন্তব্য নেই’ বলেন আইনমন্ত্রী।’
তুরিন আফরোজকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল কি না জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, যে রেকর্ড আমরা পেয়েছিলাম, তাতে যে কণ্ঠ শোনা গেছে, আমরা নিশ্চিত এটা তুরিনেরই কণ্ঠ। তারপরও যতটুকু প্রয়োজন হয়েছে তার সঙ্গে কথা বলেছি। সাক্ষীদের সঙ্গেও কথা বলেছি।
তুরিন আফরোজের অপসারণ এ সেক্টরের জন্য কোনো বার্তা বহন করছে কি না জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, আমি আশা করি এই সেক্টরে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তারা অত্যন্ত সজ্ঞানে, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গেই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তাদের নতুন করে মেসেজ দেওয়ার প্রয়োজন আমি অনুভব করি না। তারপরও যদি কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ওঠে তাহলে তো ব্যবস্থা নেবই। কারণ এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর দায়িত্ব।
মায়ের যত অভিযোগ : গত ২০ জুন তুরিন আফরোজের মা সুপ্রিমকোর্টে এক সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছিলেন, মেয়ে তুরিন তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। এরপর ৬০ শতাংশ অকেজো কিডনি নিয়ে তিনি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। উত্তরার নিজ বাড়িতে ফেরার জন্য ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ চান।
সংবাদ সম্মেলনে তুরিন আফরোজের মা শামসুন নাহার তসনিম সেদিন বলেছিলেন, ‘আজ দুই বছর তিন মাস উনিশ দিন আমি আমার বাসার বাইরে। আমার স্বামী মারা যাওয়ার আঠারো দিন পর তুরিন আমাকে বাসা থেকে বের করে দেয়। আমার দোষ তার (তুরিন আফরোজ) কিছু অনৈতিক আচরণের প্রতিবাদ করা। যেমন আমাদের ভাড়াটিয়াদের থেকে সবসময় ভাড়ার টাকা আমিই নিতাম। আমার স্বামী অবসরে যাওয়ার পর থেকেই বাড়িভাড়ার টাকায় আমাদের সংসার, ওষুধ খরচ চলত। এরপর ওর বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সে বাসা ভাড়ার টাকা জোর করে নিয়ে নেয়। অপরিচিত লোকদের রাত-বিরাত ঘরে প্রবেশ নিয়ে দারোয়ান ও ভাড়াটিয়ারা অভিযোগ করলে তার সঙ্গে প্রায়ই লাগত (ঝগড়া)। এসব বিষয়ে নিষেধ করলে ডিজিএফআই, র্যাব, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নামে ভয় দেখাত এবং বলত ওরা সবাই তার বন্ধু। কোনো কিছু বললেই ৫৭ ধারায় গ্রেফতার করার ভয় দেখাত। আমি তো ধারা বুঝি না। আরও বলত, পৃথিবীর যেখানেই থাকো সেখান থেকেই ধরে নিয়ে আসব। তিনি বলেন, গানম্যান দিয়ে ভয় দেখাত তুরিন। গ্রামের বাড়ি নীলফামারী যেতে পারি না, সে সেখানে দায়িত্ব নিয়ে জমিজমা ও বাড়ি নিজের নামে কুক্ষিগত করেছে। প্রতিবাদ করলে প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম করেও হুমকি দেয়। এরপর তিনি কেঁদে দিয়ে বলেন, ‘আমার শরীর ভীষণ খারাপ। ৬৫ শতাংশ কিডনি অকেজো। সঙ্গে আবার ডায়াবেটিসও। ওষুধ কেনার পয়সা বাড়িভাড়া থেকে পেতাম, সেটাও সে কেড়ে নিয়েছে। দেশে থাকার জায়গা নেই এখানে-সেখানে থেকে বেড়াই। আমি আমার দেশ ছেড়ে এ বয়সে কেন বিদেশে পড়ে থাকব? এ দেশ আমার জন্মস্থান ও আমার ৪৮ বছরের সংসার। আমি তো এখানেই থাকতে চাই। আমি আমার সংসারে ফিরে যেতে চাই। এজন্য আমি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।