ঘোষণা আসতে পারে, পেঁয়াজ -চালসহ নিত্যপণ্যের
মজুদদারদের ধরিয়ে দিলে পুরস্কার দিবে সরকার

পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও পেঁয়াজ ও চালের দাম বাড়ার কারণ অনুসন্ধানে মাঠে বিশেষ টিম। পেঁয়াজের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে দেশে অস্থিরতা তৈরি করতে একটি পক্ষ কাজ করছে বলে বিশেষ টিম একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন দিয়েছে। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী জড়িত রয়েছেন বলেও প্রধানমন্ত্রীর কাছে গত সপ্তাহে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিবেদন দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, বাজার সিন্ডিকেট খুঁজতে তৎপর সরকার। মজুদদারদের ধরিয়ে দিতে সরকার জনগণের সহযোগিতা চাইবে এমন সিদ্ধান্তও হয়েছে। ঘোষণা আসতে পারে, মজুদদারদের ধরিয়ে দিলে পুরস্কার। এর মধ্যে জেলা প্রশাসকদের এ সংক্রান্ত মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ জন্য গত শুক্রবার স্থানীয়ভাবে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ এবং চট্টগ্রামে স্থানীয়রা আড়তে পেঁয়াজের মজুদ সম্পর্কে স্থানীয় প্রশাসনকে
খোঁজ দিলে অভিযান চলে।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, তথ্য রয়েছে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে প- করতে আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ শুধু পেঁয়াজই নয়, চালসহ নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ে খেলাধুলা করছে। পাশাপাশি বিশ^বিদ্যালয়গুলোতেও অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে। আর এ বিষয়ের সুযোগ নিচ্ছে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা।
আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর বিরুদ্ধেও দল থেকে অভিযোগ উঠেছে। বলা হয়েছে, তিনি ঠিকমতো বাজার মনিটরিং করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও টানা দুই মাসে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি তিনি। গত বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর সামনেই সরকারদলীয় সাংসদরা পেঁয়াজ নিয়ে বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রীর সমালোচনা করেন।
আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র সংসদ সদস্য বলেন, গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী সিনিয়র দুই সাবেক মন্ত্রী এবং দুই ব্যবসায়ীকে পেঁয়াজ ও চালসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরিতে সহযোগিতা করতে বলেন। ওই দুই মন্ত্রীর সহযোগিতায় সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বাণিজ্য, কৃষি, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সমন্বয়ে গঠিত টিম গতকাল থেকেই রাজধানীসহ দেশের আড়তগুলোতে অভিযান শুরু করেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ভোক্তা সমিতির (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ভারত থেকে যে পরিমাণ আমদানি হতো, সে পরিমাণ পেঁয়াজ অন্য দেশ থেকে আসছে না। এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজি থাকতে পারে। এটা সরকারের দেখভাল করার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যদি কেউ কারসাজি করে থাকে আর এটা সরকার খুঁজে পায়, তাহলে কথা না বলে তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নেবে। তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এটাই সরকারের কর্তব্য। সরকার আকাশপথে পেঁয়াজ আনছে, এখন এর পরিমাণ পর্যাপ্ত হলে দাম কমবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পর্যাপ্ত হতে হবে। তিনি বলেন, প্রতি বছরই এ সময়টায় পেঁয়াজ নিয়ে নৈরাজ্য চলে। যখন সংকট হয় তখন সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগের কথা বলা হয়। পরের বছরের জন্য আর কোনো পরিকল্পনা থাকে না।
কৃষি অধিদপ্তরের তথ্য মতে, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৫ লাখ টন। গত মৌসুমে দেশে ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৫০ টন পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়েছে। তবে পেঁয়াজে ২০ শতাংশ ঘাটতি তৈরি হয়। সেই হিসেবে গত মৌসুমে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ছিল ১৯ লাখ টনের কিছু বেশি। অর্থাৎ ঘাটতি ছিল প্রায় ছয় লাখ টন। কৃষি অদিদপ্তরের তথ্যমতে, গত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ লাখ ৯৩ হাজার ৪৮৬ টন আমদানি হয়েছে। আর অক্টোবরে আমদানি হয়েছে এক লাখ টনেরও বেশি। এর মধ্যে ভারত থেকেই এসেছে প্রায় ৬০ হাজার টন। অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, গত পাঁচ মাসে তিন লাখ টনের বেশি পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। আর জুন ২০১৮-জুন ২০১৯ পর্যন্ত ১০ লাখ ৭ হাজার ২১৭ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। সুতরাং বাজারে চাহিদার তুলনায় পেঁয়াজের পরিমাণ অনেক বেশি আছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ভোক্তা অধিকারের পক্ষ থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দলকে মাঠে নামানো হয়েছে। তারা রাজধানীর কারওয়ান বাজার, শ্যামবাজার, কাপ্তান বাজারসহ একাধিক বাজারে নজর রাখছে। আরেকটি দল নজর রাখছে চট্টগ্রামের চাকতাই ও খাতুনগঞ্জে। খুব শিগগিরই সিন্ডিকেটের সদস্যদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা করছেন।
পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের আড়তে অভিযান চালায় বাণিজ্য, কৃষি, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সমন্বয়ে গঠিত একটি দল। এ দলে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ছিলেন ভোক্তা অধিকারের সহকারী পরিচালক আবদুল জব্বার ম-ল। তিনি জানান, অভিযানে তারা বিভিন্ন দোকানে পেঁয়াজের বিপুল মজুদ দেখেছেন। কিন্তু দাম কমাচ্ছে না তারা। সিন্ডিকেট করে পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হচ্ছে। যাদের কারণে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে, তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। সিন্ডিকেট চিহ্নিত হলে অবশ্যই তারা সাজা পাবে।
গত বুধবার বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন বলেন, যারা মজুদ করবেন এবং বাজারকে অস্থির করার চেষ্টা করবেন তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখানে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, নেত্রী বলেছেন এই সিন্ডিকেটকে চিহ্নিত করতে হবে। যারা মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে তাদের কোনো ছাড় নয়। দলের হলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।