ঢাকা শুক্রবার, ৯ই মে ২০২৫, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩২


বিস্ফোরণে বাড়ি ধসে নিহত ৭


১৮ নভেম্বর ২০১৯ ১৫:১৮

আপডেট:
৯ মে ২০২৫ ০০:২৫

রবিবার সকাল। কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য মানুষের তাড়াহুড়ো। নগরীর মহল্লাগুলোর রাস্তায় মানুষের ব্যস্ততা। ওইদিন সকালে চট্টগ্রাম নগরের পাথরঘাটার ব্রিকফিল্ড রোডেও অনেক মানুষ ছিল। কেউ স্কুলে যাচ্ছিল, কেউ অফিসে, কেউবা অন্য কোনো কাজে। কিন্তু সাড়ে ৮টার দিকে ওই রোডের বড়ুয়া বিল্ডিংয়ের কাছাকাছি রাস্তায় যারা ছিল তাদের অনেকেরই আর গন্তব্যে যাওয়া হয়নি। আকস্মিক বিস্ফোরণে বাড়িটির নিচতলার দেয়াল ধসে নিহত হয়েছে সাতজন। আহত হয়েছে ১৫ জনের বেশি। আহত ও নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল পথচারী।

ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও পুলিশের পক্ষ থেকে এ ঘটনার জন্য গ্যাস লাইনের ত্রুটিকে দায়ী করলেও কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) দাবি, গ্যাস লাইনে ত্রুটি থেকে ওই বিস্ফোরণ ঘটেনি।

চমেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক জহিরুল ইসলাম জানান, নিহতদের মধ্যে ছয়জনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন পাথরঘাটা এলাকার অ্যাডভোকেট আতাউর রহমানের স্ত্রী জুলেখা খানম ফারজানা (৩৪) ও ছেলে আতিকুর রহমান (৮), পটিয়ার মেহের আঁটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা এ্যানি বড়–য়া (৩২), নুরুল ইসলাম (৩৩), ভ্যানচালক মো. সেলিম (৪০) এবং রিকশাচালক মো. শুক্কুর (৪২)। আর ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তির পরিচয় জানা যায়নি।

আহতদের মধ্যে নয়জন চমেক হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটিসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন। তারা হলেনÑ মো. ইসমাঈল (৩০), মো. আবদুল হামিদ (৪০), মো. ইউসুফ (৪০), মো. আরিফ (১৫), মো. নাজির (৬৫), ডরিন তিশা গোমেজ (২২), সন্ধ্যা রানী দেবী (৩৫), অর্পিতা রানী দেবী (১৬) ও মো. আবু তালেব (৪৫)।

স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, পাথরঘাটার ব্রিকফিল্ড রোডের সঙ্গে লাগোয়া প্রয়াত ধর্মপাল বড়–য়ার পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় সকাল সাড়ে ৮টার দিকে হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণে ভবনের একটি দেয়াল ধসে রাস্তায় পড়ে। এ সময় ঘটনাস্থলেই নিহত হয় পাঁচজন।

আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক জসীম উদ্দিন  বলেন, খবর পেয়ে সকাল ৯টার দিকে আমরা ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছি। আগ্রাবাদ, নন্দনকানন ও চন্দনপুরার স্টেশনের ১০টি গাড়ি উদ্ধার কাজ চালায়। এ সময় প্রশাসন ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় ঘটনাস্থল থেকে ১৬ জনকে উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়। প্রাথমিকভাবে বাসার গ্যাস লাইন বিস্ফোরণ হয়ে এই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে ধারণা করা হচ্ছে। গ্যাস লাইনটি পুরনো ছিল। লিকেজ ছিল কি না তদন্ত করা হচ্ছে। এ ঘটনায় দুটি আবাসিক ভবনের প্রাচীর ও সড়কের সীমানা প্রাচীর ধসে পড়েছে।

তবে দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসা কেজিডিসিএলের জিএম (মার্কেটিং) আ ন ম সালেক সাংবাদিকদের বলেন, গ্যাস লাইনে ত্রুটি থাকার কোনো প্রমাণ তারা পাননি। তিনি বলেন, ওই বাসার গ্যাসের চুলা অক্ষত আছে। লাইনে লিকেজের কোনো আলামত আমরা পাইনি। ঘরের ভেতরে যেসব কাপড় শুকানোর জন্য ছিল সেগুলোও অক্ষত আছে। বিস্ফোরণে সীমানা দেয়াল গ্যাসের রাইজারে ওপর পড়ায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে।

এদিকে সকাল সোয়া ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের নিচতলার বাসার আসবাবপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বিস্ফোরণে পাশর্^বর্তী জনতা ফার্মেসি, স্টুডিও ফটোরুম, ঊর্মি স্টোরের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে জনতা ফার্মেসির দেয়ালও ভেঙে গেছে। পাশর্^বর্তী দুটি ভবনের দেয়াল ও সীমানা প্রাচীর ধসে পড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই বাড়ির নিচতলার ভাড়াটিয়া সন্ধ্যা রানী দেবী সকালে পূজার জন্য প্রদীপ জ¦ালাতে দেশলাই দিয়ে আগুন ধরাতে গিয়েই এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যা রানী খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি একসত্ত্বা এলাকার সুমেশ চন্দ্র নাথের মেয়ে। বোনের মেয়ে স্কুলছাত্রী অর্পিতা রানী দেবীকে নিয়ে এ বাসায় ভাড়া থাকতেন সন্ধ্যা। বর্তমানে তিনি চমেক হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটির ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন এবং ৪৫ শতাংশ দগ্ধ অর্পিতাকে ঢাকার বার্ন ইউনিটে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে।

কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন  বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে এসে পুলিশের গাড়িতে করেই আহতদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। গ্যাস লাইন বিস্ফোরণের পর ব্রিকফিল্ড রোডে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতায় যান চলাচল স্বাভাবিক করতে উদ্ধার কাজ চালানো হয়েছে।

বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থল ও হাসপাতালে হতাহতদের খোঁজখবর নিতে ছুটে যান সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মাহাবুবর রহমান, সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ, জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন। এ সময় সিটি মেয়র বলেন, ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মান্তিক। এ ঘটনা নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। পাশাপাশি নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ১ লাখ এবং আহতদের ২০ হাজার টাকা করে সহযোগিতা করা হবে।

চসিক, সিএমপি ও জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি : এদিকে বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক), চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) এ জেড এম শরীফ হোসেনকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে জানান জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন।

তিনি সাংবাদিকদের জানান, এই মর্মান্তিক ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। কমিটিতে চসিকের স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইসমাইল হোসেন বালি, কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ মহসীন এবং কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড ও ফায়ার সার্ভিসের দুজন প্রতিনিধি রাখা হয়েছে।

অন্যদিকে একইভাবে পরিদর্শন শেষে সিএমপি কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান সাংবাদিকদের জানান, এই মর্মান্তিক ঘটনা তদন্তে সিএমপির ডিসিকে (দক্ষিণ) প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ঘটনায় কারও অবহেলা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে মামলারও হুঁশিয়ারি দেন পুলিশের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন জানান, এ ঘটনা তদন্তে সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারা এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে।

 

বিকট বিস্ফোরণের পর রাস্তায় কাতরাচ্ছিল মানুষ : গতকাল রবিবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে দোকান খুলে ঝাড়া-মোছার কাজ করছিলেন চট্টগ্রামের পাথরঘাটা এলাকার ব্রিকফিল্ড রোডের জনতা ফার্মেসির বিক্রয়কর্মী অনুপম ঘোষ। শোকেসের কাচ মোছা শেষ করে মেঝে ঝাড়– দেওয়ার সময়ই বিকট বিস্ফোরণে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন তিনি। শোকেসের কাচ ভেঙে গায়ে পড়ে তার। ধুলো আর ধোঁয়ায় সব একাকার। বড়–য়া বিল্ডিংয়ের ঠিক উল্টো পাশের জনতা ফার্মেসির ওই বিক্রয়কর্মী পরে দেশ রূপান্তরকে জানান তার অভিজ্ঞতার কথা।

অনুপম ঘোষ বলেন, ‘বিস্ফোরণের দুই মিনিট পর রাস্তায় দেখি নারী-পুরুষ কাতরাচ্ছেন। হয়তো আমিও মারা যেতাম। ভগবানের কৃপায় বেঁচে গেছি। বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়ে শোকেসের কাচ এসে আমার গায়ে পড়ে। পরে দেখি রাস্তায় অনেক নারী-পুরুষ কাতরাচ্ছেন।’

ঘটনাস্থলের কাছের টং দোকানি মঞ্জুর হোসেনও এ ঘটনায় আহত হয়েছেন। তার জামা ছিল রক্তাক্ত। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি মরা থেকে বেঁচে গেছি। এতক্ষণ হয়তো আমিও মরে যেতাম। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছি। এই টং দোকানটি আমার। প্রতিদিনের মতো আজও সকালে দোকান খুলেছি। কয়েকজনকে চা-ও দিয়েছি। এর মধ্যে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দোকানের শোকেসটি আমার গায়ের ওপর পড়ে, আমি আটকে থাকি। পরে স্থানীয়রা আমাকে উদ্ধার করেছে।’

রিপন নাগ নামে বড়–য়া বিল্ডিংয়ের এক ভাড়াটিয়া বলেন, ‘আমি ভবনটির তৃতীয় তলায় থাকি। তখন মাত্র ঘুম থেকে উঠেছি। পরক্ষণেই দেখি বিকট শব্দে ভবনটি কেঁপে উঠল। তখন কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বাসার সবাই খুব ভয় গেয়ে গিয়েছিল। ফায়ার সার্ভিস আমাদের উদ্ধার করে।’