বিএনপি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে আছে-থাকবে: মির্জা ফখরুল

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্দ্বিধায়, দৃঢ়চিত্তে স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, আমরা বরাবরই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলাম, আছি এবং ভবিষ্যতেও থাকবো। সেটি আমরা সরকারে থাকি আর না থাকি। এ ব্যাপারে আপনাদের নিশ্চয়তা দিতে পারি।
রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষ্যে সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সাংবাদিকদের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল বলেন, আপনাদের বিরুদ্ধে যে নির্যাতন নিপীড়ন হয়েছে এবং যে সমস্ত আইনকানুন দিয়ে আপনাদের আটকে রাখা হয়েছিল তার বিপক্ষে কিন্তু আমরা লড়াই করেছি, করছি এবং করবো। আমরা কখনো অন্যায়ভাবে অন্যের মতকে চাপিয়ে দেয়া সমর্থন করবো না।আরেকজনের মতের স্বাধীনতাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দেব। সেটাতে আমাদের বিশ্বাস থাকুক আর না থাকুক। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আমাদের অন্যতম বিষয়। যেটি বিএনপির ৩১ দফার মধ্যে রয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আগের থেকে বেড়েছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ১৬ ধাপ আমরা এগিয়েছি। সমস্যা দেখা দেয় তখন, যখন দেখি কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠী আরেক গোষ্ঠীকে আক্রমণ করে। কোনো কোনো জায়গায় দেখা যায় কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীও এটার সঙ্গে যুক্ত হয় এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করে। আমি জানি না একটি গণতান্ত্রিক মুক্ত সমাজে এটি কতটুকু গণতন্ত্রকে জারি রাখতে কাজ করে।
তিনি আরও বলেন, আমরা গণতন্ত্র বলতে বুঝি সব মানুষের কথা বলা, ভোট দেয়ার স্বাধীনতা। যে নিজে যেটায় বিশ্বাস করে সেটার সঙ্গে অন্যে যেটা বিশ্বাস করে সেটাকে সমানভাবে মর্যাদা দেয় এবং সহনশীল থাকে। আমরা বলছি সংবাদপত্র যেটা বলতে চাইবে সেটাকে গ্রহণ করা বা পছন্দ না হলে বর্জন করা সব ঠিক আছে। কিন্তু সে প্রতিষ্ঠানকে উড়িয়ে দেয়া, তার ওপর মব জাস্টিস প্রয়োগ করা এগুলোকে আমরা গণতন্ত্রের মানদণ্ড হিসেবে দেখতে পারি না।
মির্জা ফখরুল বলেন, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ অনেক বিশাল ব্যাপার। ওটাকে কেন্দ্র করে আমাদের সকল চিন্তা আবর্তিত হয়। আমরা সেটার জন্য লড়াই করেছি, প্রাণ দিয়েছি। দীর্ঘ নয় মাস আমরা অবিশ্বাস্য রকমের কষ্টের মধ্য দিয়ে পার করেছি। এখানে আমরা আপস করতে চাই না। এটাকে অনেকে পছন্দ করতেও পারেন আবার নাও করতে পারেন। তাতে আমি বা আমরা কিছু মনে করি না। কারণ এটাই আমাদের মূল ভিত্তি। এরপর আমরা বহু আন্দোলন করেছি। সংগ্রাম করেছি। লড়াই করেছি।
তিনি বলেন, বিএনপি হিসেবে আমরা বলতে চাই যে, আমার দলইতো প্রথম যারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে ওপেন করেছিল ১৯৭৫ সালে। তার আগে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশালের সময় সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। চারটি সংবাদপত্র ছাড়া সব নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সব সংবাদপত্রকে স্বাধীন করেছিলেন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা বলি না যে আমরা ধোয়া তুলসিপাতা না, কিন্তু এ কথা নিশ্চয় বলতে পারি আমরা নিঃসন্দেহে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য অনেক বেশি কাজ করেছি। অনেক মিডিয়া আমাদের সময় তৈরি করা। আমাদের সময় সংবাদপত্র ও সংবাদকর্মীদের ওপর নির্যাতন নিপীড়ন তুলনামূলকভাবে নিঃসন্দেহে অনেক কম ছিল। আমরা এখনো পর্যন্ত বিশ্বাস করি।
তিনি বলেন, আমরা একটা রূপান্তরের মধ্যে রয়েছি। অনেক রকম চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কিন্তু গণতন্ত্র যদি সত্যিকার অর্থে আমরা চাই তাহলে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে হবে। চিন্তা-ভাবনা গণতান্ত্রিক করতে হবে। আমি যদি মনে করি যা বলবো সেটাই সঠিক তাহলে কোনোভাবেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবো না। একইভাবে সংবাদমাধ্যমগুলো আমরা কথা বললে ঠিক আছে নতুবা ঠিক নাই- এ ধরনের চিন্তাও কিন্তু গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে না।
তিনি আরও বলেন, সংকট হচ্ছে গণতন্ত্রইতো নেই, গত ১৫ বছর পর্যন্ত লড়াই করেছি গণতন্ত্রের জন্য। '২৪-এর জুলাইয়ের আন্দোলনের কারণে একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু এটি রাতারাতি হয়নি। দীর্ঘ সংগ্রাম ও চর্চার ফসল। গণতন্ত্র চর্চা করতে হয়। হঠাৎ করে গণতন্ত্র গড়ে তুললাম- এমন হয় না। আরেকটা ক্ষেত্রে গণতন্ত্র হয় না। যে এটাই করতে হবে। এ মানসিকতায় গণতন্ত্রের চর্চা হয় না। আরেকটা বিষয় হচ্ছে জনগণের ওপর আস্থা রাখতে হবে। তার চিন্তা ভাবনা, রায়ের প্রতি আস্থা রাখতে হবে।
বিএনপির শীর্ষ এ নেতা বলেন, কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম বলছে, তারা যা বলছে তা ঠিক, অন্যেরা ভুল। তা না হলে সে ফ্যাসিস্ট, ভারত ও আওয়ামী লীগের দোসর। এটা ঠিক না। আমি আগেও বলেছি যে, এতুটুক কথা কেটে প্রচার করে দেয় যে, আমি ভারতীয় দোসর। এটা যেন না হয় সে জন্য আমাদের সজাগ হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, বিশেষ করে আমরা যারা বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চাই তাদের দায়িত্বটা অনেক বেশি। তরুণদেরও এটা মাথায় রাখতে হবে। তা না হলে হাজার হাজার তরুণের রক্ত এবং ১৫ বছর ৬০ লক্ষ মানুষের লড়াই ম্লান হয়ে যাবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘যখন গণমাধ্যমের কথা বলি, এখানে অনেক আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। এই সরকারের সময়েও আলোচনা রয়েছে। যেহেতু আমি তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ছিলাম, সেজন্য অনেকগুলো সমালোচনা আমার ওপরে আসলে বর্তায়। আমরা একটা কথা বিভিন্ন সময় বলেছি-বিগত ১৬ বছর একটা ফ্যাসিস্ট শাসনের মধ্য দিয়ে অন্য সকল প্রতিষ্ঠানে যে ধরনের দলীয়করণ হয়েছে এবং ফ্যাসিজমের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত হয়েছে গণমাধ্যমও এরমধ্যে অন্যতম প্রতিষ্ঠান।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিগত সময়ে মিডিয়া ও ফ্যাসিজমের যে সম্পর্ক ছিল, যদি সেই সম্পর্ক থেকে, সেই আদর্শিক আধিপত্য জায়গা থেকে যদি মিডিয়া বের না হয়, তাহলে জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী যে মুক্ত গণমাধ্যমের প্রত্যাশা করি, জনগণের মিডিয়ার প্রতি যে আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা সেটি সুস্পন্ন হবে না।’
ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, আজকে আমাদের এটা উপলব্ধি করতে হবে- আমরা গণমাধ্যম জনগণের সেবার কাজে নিয়োজিত। আমরা দেশপ্রেমিক, সমাজকে উন্নত করতে চাই, বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, মত প্রকাশে বিশ্বাস করি এবং সমস্ত কাজ সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই। তবে এটা সত্য আমাদের গণমাধ্যম মুক্ত না । শেখ হাসিনা রিজিম জনধিককৃত হয়েছিল তার অন্যতম কারণ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছিল না।
দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, যে দেশে প্রশ্ন করার জন্য সাংবাদিকের চাকরি যায়, সেই দেশে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করছি। খুব অবাক লাগে, আমি বিস্মিত হই। জানি না আমি কাকে দায়ী করবো। আমি কি সরকারকে দায়ী করবো, না; মালিককে দায়ী করবো, না; সাংবাদিক ইউনিয়ন কী করেছে। আমাদের সম্পাদক পরিষদ, যেটাতে আমি প্রতিষ্ঠাকালীন থেকে আছি, ট্রেজার হিসেবে আছি। আমি মনে করি আমরাও ব্যর্থ হয়েছি। যাই হোক আত্মসমালোচনা আমাদের দরকার যে, আমরা কতটুকু করতে পেরেছি।’
তিনি বলেন, ‘তবে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে অনেকখানি। একবছর আগে যে অবস্থা ছিল, সেই অবস্থা এখন আর নেই। অনেকখানি পাল্টেছে। তবে আমার হতাশ হচ্ছি-বেশ কিছু অ্যাকশানের কারণে।’
নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, যখন সারা দুনিয়ায় প্রতি বছর একবার করে মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালন করতে হয়, তার মধ্যদিয়ে প্রমাণিত হয় সারা পৃথিবীতে গণমাধ্যম নানা প্রতিকূলতার মধ্যে কাজ করে।
সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও দ্য ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনামের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় এতে আরও বক্তব্য রাখেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি এবং জাতীয় প্রেস ক্লাসের সভাপতি কবি হাসান হাফিজ।