কার্যালয়ে মদ-নারী নিয়ে ফুর্তি
মঞ্জুর চাঁদাবাজির টাকা যেত প্রভাবশালী ও পুলিশের পকেটে

রাজধানীর টিকাটুলির ত্রাস ছিল কাউন্সিলর ময়নুল হক মঞ্জু। তার ভয়ে কেউ থানায় অভিযোগ করতে সাহস পেত না। কেউ অভিযোগ করতে গেলেই বিষয়টি থানা থেকে তাকে জানিয়ে দেওয়া হতো। মঞ্জু কখনও সরাসরি, আবার কখনও তার লোকজন দিয়ে অন্যের জমি দখল করত। রাজধানী সুপার মার্কেট ও চৌধুরী সুপার মার্কেটে চলত তার চাঁদাবাজির মহোৎসব।
মঞ্জু কাউন্সিলর হওয়ার পরই নিজস্ব বাহিনী নিয়ে ত্রাসের রাজত্ব শুরু করে। তার বিরুদ্ধে একটি মার্কেট দখল ও ফুটপাথে চাঁদাবাজি এবং বিভিন্নজনের জমি-বাড়ি দখলের অভিযোগ রয়েছে। অথচ থানা পুলিশ বলছে, বিষয়টি নাকি তারা জানতই না। পুলিশ আরও বলছে, রাজধানী সুপার মার্কেটে তার চাঁদাবাজি নিয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য ছিল না। কিন্তু র্যাব বলছে, মঞ্জু এলাকার একজন চিহ্নিত চাঁদাবাজ ছিল। এলাকায় এমন হীন কাজ নেই তার মাধ্যমে হতো না। তার গ্রেফতারের পর এলাকাবাসী খুশি হয়ে মিষ্টি বিরতণ করেছে।
চাঁদাবাজি ও মার্কেট দখল : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মঞ্জুর লোকজন রাজধানীর সুপার মার্কেট ও চৌধুরী মার্কেট ছাড়াও এলাকার বিভিন্ন ফুটপাথ থেকে চাঁদা তুলত। চাঁদা না দিলে দোকানদারদের দোকান করা বন্ধ করে দিত তার লোকজন। এই চাঁদার ভাগ পেত ওয়ারী থানা পুলিশ ও প্রভাবশালীরা। রাতারাতি অনেকের জমি ও বাড়ি দখল করে। এসব অভিযোগ নিয়ে অনেকেই থানায় গেছেন কিন্তু পুলিশ তা আমলে নেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। তা ছাড়া থানার মধ্যে তার লোকজন সারাক্ষণ বসে থাকত। এসব কারণেও অনেকে থানায় অভিযোগ দিত না। ওয়ারী থানার ওসি আজিজুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, তার বিরুদ্ধে আগে থানায় কখনই কেউ অভিযোগ করেনি। আর রাজধানী সুপার মার্কেটে তার চাঁদাবাজির কথা আমাদের জানা নেই। হয়তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে থাকতে পারে।
মঞ্জুর রাজধানী সুপার মার্কেটে দোকানের ব্যবসাও রয়েছে। এই মার্কেট পরিচালনায় তিনি সভাপতির পদ জোর করে দখল করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই পদ বাগিয়ে শুরু হয় তার চাঁদাবাজি। প্রতি মাসে এই মার্কেট থেকে তার পকেটে ঢুকত ১০ লাখ টাকা। এ ছাড়াও টিকাটুলি এলাকায় থাকা চৌধুরী মার্কেট নামের আরেকটি মার্কেটেও তার চাঁদাবাজি চলত। মার্কেটটি ১০ বছর আগে কাউন্সিলর হওয়ার পরই রাতারাতি তার লোকজন দিয়ে দখলে নেয়। মার্কেটের মালিক বিষয়টি নিয়ে সিটি করপোরেশন ও থানা পুলিশের কাছে অভিযোগও করেছিলেন, কিন্তু তারা কেউই তাকে সাহায্য করেনি। বাধ্য হয়ে মার্কেটের মালিক আশা ছেড়ে দেয়। পরবর্তীতে এর পুরো নিয়ন্ত্রণ নেয় মঞ্জু। এই মার্কেট থেকে তার প্রতি মাসে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা শুধু ভাড়াই আসত।
কার্যালয়ে মদ-নারী নিয়ে ফুর্তি : মঞ্জু কাউন্সিলকে বাধা দেওয়ার মতো ওই এলাকায় কোনো লোক ছিল না। এ কারণে কাউন্সিলর বা জনপ্রতিনিধি হয়েও তিনি তার কার্যালয়ে বসে নারী নিয়ে ফুর্তি করত এবং প্রকাশ্যে মদ খেত। মদ খেয়ে প্রায়ই সময় মঞ্জু কার্যালয় ছাড়াও রাস্তায় মাতলামি করত বলে জানা গেছে। সালাম নামের এক ব্যক্তি বলেন, মদ না খেলে তার দিনই কাটত না। নিয়মিত মদ খাওয়ার কারণে অনেক সময় কাজকর্মও করতে পারত না।
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে : ২০০১ সাল থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে মঞ্জু। এরপর সে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কমিটির সদস্য পদ বাগিয়ে নেয়। আওয়ামী লীগ সরকার আবারও ক্ষমতায় আসলে কাউন্সিলর হয়। পরপর দুবার কাউন্সিলর হওয়ায় তার ত্রাসের রাজত্বের পরিধি বাড়তে থাকে। নিজের অনুসারীদের নিয়েই একটি বাহিনী গড়ে মঞ্জু।
আমেরিকায় নিয়মিত টাকা পাঠাত মঞ্জু : মঞ্জু কাউন্সিলর হওয়ার পর সব পরিবর্তন হতে থাকে। তার একটি দোকান ও কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য সম্মানী ছাড়াও আর কোনো আয় ছিল না। কিন্তু তারপরও সে রাজকীয়ভাবে চলত। ছেলে ও মেয়েকে পড়ালেখা করায় আমেরিকায়। সেখানে সে প্রতি মাসেই হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাত বলে জানা গেছে। এই তথ্য র্যাবের কাছেও মঞ্জু আটকের পর স্বীকার করে।
১০ দিনের রিমান্ডে মঞ্জু : এদিকে র্যাবের করা অস্ত্র ও মাদক আইনের দুই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হক মঞ্জুকে মোট ১০ দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ। তার গাড়িচালক সাজ্জাদকে মাদক মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। শুক্রবার পুলিশের রিমান্ড আবেদনের ওপর শুনানি শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম ধীমান চন্দ্র মণ্ডল শুক্রবার এ আদেশ দেন।