ঢাকা রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


২০৪৮ সালে রাষ্ট্রক্ষমতার মসনদে বসার টার্গেট জামায়াতের!


৮ অক্টোবর ২০২১ ১৮:১৭

আপডেট:
৮ অক্টোবর ২০২১ ১৮:৫০

 

২০৪৮ সালে রাষ্ট্রক্ষমতার মসনদে বসার টার্গেট

দেশের ২৫টি খাতে অন্তত দেড় লাখ কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনা

ক্যাম্পাসভিত্তিক প্রচুর সাংবাদিক তৈরি করা!

নিজেদের শিক্ষা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি

আইনঙ্গন একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা!

বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে সমর্থন বাড়ানো।

এনজিওর আড়ালে বিদেশ থেকে আসছে প্রচুর অর্থ!

শিবিরকর্মী তৈরি করে ছাত্রলীগের মধ্যে তাদের প্রবেশ করিয়ে দিয়ে
সংগঠনকে দুর্বল করা এবং ছাত্রলীগের ব্যানারে সরকারি চাকরি নেওয়া।

 

যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত নিবন্ধনবিহীন রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামী নতুন ছকে হাঁটার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। কীভাবে দলকে আরও সংগঠিত করা যায় তা নিয়ে দেশ-বিদেশে চালানো হচ্ছে আলোচনা। তাছাড়া দলটির শীর্ষ নেতারা গোপনে বৈঠকের পর বৈঠক করছেন। বর্তমান নাজুক পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে অবস্থান মজবুত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন সংগঠনটির নেতারা। আর এজন্য দেশের ২৫টি খাতে অন্তত দেড় লাখ কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এমনকি ২০৪৮ সালে রাষ্ট্রক্ষমতার মসনদে বসার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সংগঠনটি।

দেশজুড়ে জেলা-উপজেলায় কমিটি গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছেন দলটির নেতারা। পাশাপাশি চারশোর বেশি ট্রেড ইউনিয়নের কৃষক-শ্রমিকদের দলে ভেড়ানোরও পরিকল্পনা আছে। রয়েছে নিজেদের শিক্ষা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যও। সেখানে তরুণদের ভেড়ানোর চেষ্টা করা হবে। আর এজন্য বিদেশ থেকে বিভিন্ন এনজিওর আড়ালে আসছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। সম্প্রতি রাজধানীর ভাটারা থেকে গ্রেপ্তার হওয়া দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ ৯ শীর্ষ নেতা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এমন সব চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন বলে গোয়েন্দা পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।

এদিকে জামায়াত নেতাদের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে নড়েচড়ে বসেছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নিয়ে সংগঠনটির পলাতক নেতাদের ধরতে বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। পাশাপাশি জামিনে যারা রয়েছেন তাদেরও তালিকা করা হচ্ছে। পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, আত্মগোপনে থাকা জামায়াত নেতারা দলকে সংগঠিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। পাশাপাশি তারা ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কিছু নেতাদের ম্যানেজ করে এলাকায় নির্বিঘ্নে বসবাস করছেন। অভিযোগ আছে, অসাধু পুলিশ সদস্যদের সঙ্গেও জামায়াত নেতাদের সখ্য আছে। এর পাশাপাশি সংগঠনটির ছাত্র শাখা ইসলামী ছাত্রশিবিরও তৎপর রয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগীয় অঞ্চলে তাদের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উত্তর বিভাগের যুগ্ম কমিশনার হারুন-অর-রশিদ  বলেন, গত ৬ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ, রফিকুল ইসলাম খান, নির্বাহী পরিষদের সদস্য ইজ্জত উল্লাহ, মোবারক হোসেন, আবদুর রউফ, ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ইয়াসিন আরাফাত এবং জামায়াতকর্মী মনিরুল ইসলাম ও আবুল কালামকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর দুই দফা রিমান্ডে নিয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য পাওয়া যায়। নিবন্ধন হারানোর পর ২০১৮ সাল থেকে ৩০ বছরের জন্য মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে তারা মাঠে নামে। তাদের পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে, ২০৪৮ সালে ক্ষমতায় যেতে সরকারি ২৫ সেক্টরে দেড় লাখ লোকের নিয়োগের ব্যবস্থা করা।

চার শতাধিক ট্রেড ইউনিয়নের ব্যানারে কৃষক ও শ্রমিকদের একত্রিত করা। এজন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান দিচ্ছে দলটির বিদেশে থাকা কর্মীরা। বিভিন্ন এনজিওর আড়ালে অর্থ আসার তথ্য পাওয়া গেছে। তথ্যগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে ২০১৩ সালে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে হাইকোর্ট। ২০১৮ সালে এটি গেজেট আকারে প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। এর আগে নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে দলটি ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করে। কিন্তু বর্তমানে টানাপড়েনের কারণে নিজস্ব ধারার রাজনীতিতে ফেরার চেষ্টা করছে দলটি। এর আগে সরকারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াত-শিবির দেশজুড়ে তাণ্ডব চালায়। পেট্রলবোমা হামলা এবং বাসে আগুন দিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যার মতো অভিযোগ উঠে দলটির বিরুদ্ধে। নির্বাচনকালীন সময়ে ভোটকেন্দ্র পুড়িয়ে দেওয়া এবং প্রিসাইডিং অফিসারকে হত্যার মতো কাজ করতেও দ্বিধাবোধ করেনি তারা। মিসর ও তুরস্কে থাকা দুটি দলকে এখন নিজেদের আদর্শ ভেবে আগামী নির্বাচন ঘিরে দলটি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক নাশকতা চালাতে এখন থেকেই দল গোছানো হচ্ছে বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। গ্রেপ্তার হওয়া নেতাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের একটি তালিকা করা হয়েছে। সেই তালিকা নিয়ে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম।

গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্যমতে, একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে ২০৪৮ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার পরিকল্পনা এঁটেছে জামায়াতে ইসলামী। গ্রেপ্তার নেতাদের ল্যাপটপ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী সারা দেশে প্রায় ৪০০ ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠেছে জামায়াতে ইসলামীর ব্যানারে। এছাড়া তাদের একটি শ্রমিক সংগঠনও রয়েছে। কৃষক-শ্রমিকসহ খেটে খাওয়া মানুষকে ওই সংগঠনের ব্যানারে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। জামায়াতে ইসলামী পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এ ক্ষেত্রে টার্গেট করা হচ্ছে তরুণ প্রজন্মকে। চাকরির বিনিময়ে কর্মী সংগ্রহ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সাংবাদিক সমিতি নিয়ন্ত্রণ নেওয়া এবং ক্যাম্পাসভিত্তিক শিবিরের রাজনীতি চাঙ্গা করা। একই সাথে ক্যাম্পাসভিত্তিক প্রচুর সাংবাদিক তৈরি করা

এ প্রসঙ্গে গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা  বলেন, ‘দেশে বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করেছে জামায়াত। যেখানে বিদেশ থেকে ফান্ড এনে তারা মূলত দলের জন্য ব্যবহার করছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল কর্মী তৈরি করে ছাত্রলীগের মধ্যে তাদের প্রবেশ করিয়ে দেওয়া। তার ব্যানারে সরকারি চাকরি নেওয়া। আবার হেফাজতের মধ্যেও তাদের লোক ঢুকিয়ে দিয়েছে। রিমান্ডে থাকাকালে গ্রেপ্তার নেতারা জানিয়েছেন, সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নকাজকে তারা তাদের কর্মী ও দেশি-বিদেশি মিডিয়া ব্যবহার করে মøান করে অপপ্রচার চালাবে এমনও পরিকল্পনা আছে। এজন্য বিদেশে তাদের একটি শক্তিশালী সাইবার ইউনিট রয়েছে। তারা বিদেশে বসে জামায়াতের হয়ে সরকারবিরোধী অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে জামায়াত-শিবিরের অসংখ্য নেতাকর্মী বিদেশে যান। তারা সেখান থেকে প্রতি মাসেই দলের জন্য বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছেন বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।’

সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, সরকারের হাইকমান্ডের নির্দেশে জামিনে থাকা জামায়াত-শিবিরের নেতাদের তালিকা হচ্ছে। তালিকায় প্রত্যেকের নাম, বাবার নাম, বর্তমান ঠিকানা, স্থায়ী ঠিকানা, পেশা, দলীয় অবস্থান, নেটওয়ার্ক, অর্থের উৎস ও মামলার রেকর্ডের বিবরণ রাখতে বলা হয়েছে। ঢাকার ১২৮টি ওয়ার্ড এবং রাজশাহী, চট্টগ্রাম, টেকনাফ, খুলনা, যশোর, কুমিল্লা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সিলেটসহ আরও কয়েকটি এলাকায় জামায়াত-শিবিরের আনাগোনা বেশি। শহর এলাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে ৩০-৪০ জন নেতাকর্মীর নাম উঠে আসছে তালিকায়।

পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা  বলেন, ‘জামায়াত-শিবিরের কোনো ধরনের তৎপরতা চালাতে দেওয়া হবে না। যারা জামিনে এলাকায় আছে নজরদারির আওতায় রাখার পাশাপাশি তাদের তালিকাও করা হচ্ছে। নাশকতা মামলার পলাতক আসামিদের ধরতে পুলিশ আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। কেউ নাশকতার চেষ্টা করলে তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে।’

এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া জামায়াত নেতাদের কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। দলটি নানা পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বলে তারা জানিয়েছে। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা ও মীর কাসেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর তারা কিছুদিন চুপচাপ ছিল। এখন আবার সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে।’