ঢাকা সোমবার, ৬ই মে ২০২৪, ২৪শে বৈশাখ ১৪৩১


তৃণমূলে আ.লীগের বেহাল দশা


১৪ নভেম্বর ২০২১ ২১:৪৭

আপডেট:
১৪ নভেম্বর ২০২১ ২১:৪৭

গত দুই ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহীদের দাপট, সহিংসতায় অস্বস্তিতে পড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। মনোনয়ন বোর্ডের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে স্বতন্ত্রের নামে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর বহর এবং তাদের জয়-জয়কারে দলটির তৃণমূলের সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা ও দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়েছে। মনোনয়ন বোর্ডের নির্দেশনা উপেক্ষা করে দলীয় প্রতীকের বাইরে দ্বিগুণ সংখ্যক বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। এর মধ্যে দুই দফায় ১১৯৮টি ইউপিতে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের চার শতাধিক বিদ্রোহী। প্রশ্ন উঠেছে, নির্বাচনের আগে বিদ্রোহীদের বিষয়ে যে কঠোর নির্দেশনা ছিল ‘তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হবে’ তা অব্যাহত থাকবে কি না?

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বড় একটি অংশের বক্তব্য, বিদ্রোহী হলেও নির্বাচিতরা নৌকারই লোক। নৌকা প্রতীক নিয়ে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারাও নৌকার আর বিদ্রোহীরাও নৌকার। বিএনপি তো নির্বাচনে অংশ নেয়নি। বিদ্রোহী প্রার্থীদের কারণে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর হয়েছে। তারা মনে করেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকের বাইরেই হওয়াই ভালো। তাতে তৃণমূলে ভালো প্রার্থীর মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়ে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের আরেক অংশ বলছে, ২৮ নভেম্বরসহ তিন দফায় ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের জয়-জয়কার নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তালগোল পাকিয়ে ফেলার অবস্থা তৈরি হয়েছে দলে। তৃণমূলের নির্বাচিত এত বিশালসংখ্যক প্রতিনিধিকে বহিষ্কার করা যেমন ঝুঁকি, তেমনি দলীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে তাদের বিষয়ে নমনীয় থাকাও ঝুঁকি। ফলে তৃণমূলের বিদ্রোহীদের নিয়ে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অনেকটা বেকায়দা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতারা আরও বলছেন, ২৮ নভেম্বরের অনুষ্ঠিতব্য ইউপি নির্বাচনসহ তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা দেখে এটাই বোঝা যাচ্ছে যে, দলে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা তৃণমূলে ভেঙে পড়েছে। তারা বলছেন, এই চিত্র থেকে দলকে ফেরাতে না পারলে জাতীয় নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

দলের একাধিক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেছেন, তৃণমূলে অনেক এমপি (সংসদ সদস্য) কেন্দ্রের সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করেছেন। আসলে তৃণমূলে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি এখন ‘এমপি লীগ’ তৈরি হয়েছে। আগামী সংসদ নির্বাচনে অনেকেই মনোনয়ন পাবেন না এমন এমপিরা তৃণমূলে বিশৃঙ্খলা তৈরিতে নেমেছেন। তারা স্থানীয় পর্যায়ে যারা দলীয় রাজনীতি করেন এবং ত্যাগী তাদের বাদ দিয়ে ‘হাইব্রিড’ এবং তাদের আত্মীয়স্বজনকে স্থানীয় সরকারে নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে সুযোগ করে দিচ্ছেন।

পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা জানান, দলকে এখন ‘এমপি লীগ’ মুক্ত করতে হবে। বিদ্রোহী প্রার্থীদের শাস্তি দিলেই হবে না, তাদের যারা পৃষ্ঠপোষক তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হবে।

আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেছেন, গত ২১ জুন প্রথম দফার ইউপি নির্বাচন থেকেই বিদ্রোহী প্রার্থীদের দাপট বাড়ছিল। দল থেকে কঠোর অবস্থানও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এতটাই প্রকট কেন্দ্রীয় নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। তা ছাড়া বারবার বিদ্রোহীদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসাও এর জন্য দায়ী।

সর্বশেষ দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে কারণ দর্শানোর নোটিস, বহিষ্কার, ভবিষ্যতে দলীয় পদ-পদবি এবং মনোনয়ন না পাওয়া, দলের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে কোনো নোটিস ছাড়াই দল থেকে বহিষ্কার, তৃণমূল থেকে সমঝোতার ভিত্তিতে কেন্দ্রে নাম পাঠানো কোনো উদ্যোগই কাজে লাগেনি।

আওয়ামী লীগ দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব এবং অনেক সংসদ সদস্য মনে করছেন, এরপর থেকে ইউপি নির্বাচনে আর দলীয় প্রতীক রাখা ঠিক হবে না। গত ২৫ অক্টোবর স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের সভায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক প্রশ্নে শীর্ষ নেতাদের আবারও মতামত নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সভায় বেশিরভাগ সদস্যই ইউপি নির্বাচনে প্রতীক না রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। মনোনয়ন বোর্ড সভায় দলের সভাপতিমণ্ডলী ও মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম সেদিনই তার নির্বাচনী আসন গোপালগঞ্জ-২-এ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন উন্মুক্ত রাখার প্রস্তাব দেন।

ওই বৈঠকে সদস্যরা বলেছেন, প্রতীক বরাদ্দের মধ্য দিয়ে নির্বাচন হলেও নৌকার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতারাও। এর বিরুদ্ধে কেন্দ্র থেকে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও বিদ্রোহী দমনে ব্যর্থ হচ্ছ দলটি। এই ইস্যুটি মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরা দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সামনে উপস্থাপন করেন। কয়েক সদস্য ইউনিয়ন পরিষদে অন্তত প্রতীক না রাখতে পরামর্শ দেন।

আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা এ প্রসঙ্গে গতকাল বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী দমন করতে হলে, প্রতীক তুলে দিতে হবে। এর মধ্যে অনেক সংসদ সদস্যও কেন্দ্রে এই প্রস্তাব দিয়ে চিঠি দিয়েছেন। কোন চেয়ারম্যান প্রার্থী যোগ্য-অযোগ্য সেটা স্থানীয় জনগণই নির্বাচন করবে। এতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্যরা নির্ভার থাকতে পারবেন। এখন জেলা-উপজেলা ও সংসদ সদস্যদের প্রার্থী বাছাইকে কেন্দ্রে করে যে বেগ পেতে হয় সেটা আর থাকবে না।

আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্যাহ বলেন, মনোনয়ন বোর্ডের সর্বশেষ সভায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতীক রাখা হবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি বলেন, বিদ্রোহীদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান রয়েছে। দলীয় সভাপতির নির্দেশনা অনুযায়ীই কাজ হবে।

দলের অপর সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান বলেন, বিদ্রোহীদের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আর যারা দলীয় শৃঙ্খলা মানেনি তাদের বিষয়ে অবশ্যই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সেটা দলীয় সভাপতি সিদ্ধান্ত নেবেন।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বলেন, যারা বিদ্রোহ করছে, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে, ইতিমধ্যে কয়েক জায়গায় হয়েছেও। বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করলেও আমরা তাকে আর মনোনয়ন দিচ্ছি না, দল থেকে বহিষ্কার হচ্ছে। এখন দলের বাইরে গিয়ে যদি কেউ নির্বাচন করে, তাহলে তো আর করার কিছু নেই।

এদিকে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থীদের থামাতে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তৃণমূলে পাঠানো এক চিঠিতে ওবায়দুল কাদের লিখেছেন, “গভীর উদ্বেগের বিষয় এই যে, দেশের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন এবং নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে সৃষ্টিতে লিপ্ত রয়েছেন। বিষয়টি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে।”

ওই বার্তায় আরও বলা হয়েছিল, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ থেকে পাঠানো প্রস্তাব এবং আবেদনকারীদের তথ্য-উপাত্ত যাচাই ও মাঠ জরিপের ভিত্তিতে চেয়ারম্যান প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তাই বিদ্রোহী প্রার্থী যারা হয়েছেন, তাদের ভোটের মাঠ ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

ওবায়দুল কাদেরের ওই বার্তায় বলা হয়, “অন্যথায় গঠনতন্ত্রের ৪৭ ধারা অনুযায়ী সকল বিদ্রোহী প্রার্থী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানকারী আওয়ামী লীগসহ সকল সহযোগী সংগঠনের নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা প্রদান করছি।”

দলের সাধারণ সম্পাদকের এই কঠোর বার্তার পরও বিদ্রোহী প্রার্থী দমন করা যায়নি এবং নির্বাচনী সহিংসতা বন্ধ করা যায়নি।

নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় তৃতীয় ধাপে ১০০৩ ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে ৫ হাজার ২৮৫ জনের মনোনায়নপত্র জমা পড়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা দলীয় প্রার্থীর দ্বিগুণ।

এর মধ্যে ২০টি রাজনৈতিক দল থেকে প্রার্থী হয়েছেন ১,৭৪৭ জন। বাকি ৩,৫৩৮ জনই স্বতন্ত্র প্রার্থী। আওয়ামী লীগের ৯৮১ জন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ৪৩৮ জন, জাতীয় পার্টির ১৮৭ জন, জাকের পার্টির ৬৪ জন এবং জাসদের ২৫ জন। বাকিরা স্বতন্ত্র।

১১ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৬ ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রার্থী ১৪২৫ জন, স্বতন্ত্র প্রার্থী তার দ্বিগুণের কাছাকাছি, ২৬৫৫ জন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী ৮৩৮ জন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ৩৬৮ জন, জাতীয় পার্টির ১০৭ জন।