ঢাকা রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৬ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


জুয়ায় কেউ হেরে গিয়ে পাগলামি করলে তার মেম্বারশিপ কার্ড বাতিল হয়ে যায়

সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি জুয়াড়ি সহস্রাধিক


২৮ অক্টোবর ২০১৯ ০০:৪৩

আপডেট:
১৯ মে ২০২৪ ০৭:২৩

সিঙ্গাপুরের ক্যাসিনোতে জুয়া খেলে কেউ কেউ হচ্ছেন কোটিপতি, কেউ কেউ হচ্ছেন নিঃস্ব। তারপরও থেমে নেই ক্যাসিনোয় যাতায়াত। ক্যাসিনোগুলো দিন-রাত সরগরম থাকে জুয়াড়িদের আনাগোনায়। তাদের মধ্যে বাংলাদেশি ও ভারতীয়দের তৎপরতাই সবচেয়ে বেশি।

গত ২০ ও ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে জনপ্রিয় জুয়ার আসর বেফ্রন্ট মেরিনা বে স্যান্ডেইজ ক্যাসিনো ও সেন্তুসা রেস্টওয়াল ক্যাসিনো ঘুরে জানা গেছে, তালিকাভুক্ত বিভিন্ন দেশের লোকই মূলত সেখানে খেলতে পারেন। তালিকায় সহস্রাধিক বাংলাদেশির নাম রয়েছে। তাদের মধ্যে আছেন বেশ কয়েকজন বর্তমান ও সাবেক সংসদ সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। আছেন বেশ কিছু শ্রমিক। ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিকও সেখানে বেশ সক্রিয়। সিঙ্গাপুরের লোকদে আয়কর পরিশোধ করেই খেলার শর্ত থাকায় ক্যাসিনোতে তাদের আনাগোনা বেশ কম।

মেরিনা ক্যাসিনোর নিরাপত্তা কর্মকর্তা মিস্টার লি  জানান, ১ কোটি ৩ লাখ স্কয়ার ফিটের এই ভবনে ক্যাসিনো খেলার জন্য আছে ৫শ টেবিল ও ১৬শ বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম। চারটি ফ্লোরে নিয়মিত জুয়া খেলা হয়। এর মধ্যে ৪র্থ তলায় মোস্ট ভিভিআইপি, ৩য় তলায় ভিআইপি, ২য় তলায় ‘মাঝারি’ ও নিচ তলায় ‘মুটোমুটি সচ্ছল’ লোকেরা জুয়া খেলেন। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশের লোকজনদের মধ্যে বেশিরভাগই ২য় ও ৩য় তলায় খেলেন। বাংলাদেশে ক্যাসিনো কাণ্ডে আলোচিত ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভুঁইয়া, বহিষ্কৃত সহসভাপতি এনামুল হক আরমান, যুবলীগ নামধারী বিতর্কিত ঠিকাদার জিকে শামীম, শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানসহ অন্যরা ৩য় তলায় বসেন।

সম্রাটের চতুর্থ স্ত্রী সিঙ্গাপুরের নাগরিক চিনলি তাদের সবার ‘দেখাশুনা’ করেন। ৪র্থ তলায় খেলেন বেশ কয়েজন সংসদ সদস্য, ক্রিকেট বোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীরা। দ্বিতীয় তলায় ও নিচ তলায় খেলেন সিঙ্গাপুরে অবস্থান করা বাংলাদেশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। তাদের সঙ্গে সিঙ্গাপুরসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশের লোকজনও অংশ নেন। সেন্তুসা রেস্টওয়াল ক্যাসিনোর চিত্রও অনেকটা এরকম বলে জানান মিস্টার লি।

মেরিনা বে স্যান্ডেইজ ক্যাসিনো ও সেন্তুসা রেস্টওয়াল ক্যাসিনোর একাধিক কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশে ক্যাসিনো কারবারের ‘গডফাদার’ হিসেবে পরিচিত সম্রাট গত সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সিঙ্গাপুর এসেছিলেন। জুয়া খেলে মেরিনা ও রেস্টওয়াল ক্যাসিনোতে। আরমানসহ যুবলীগের অন্তত এক ডজন নেতাকর্মী তার সঙ্গে ছিলেন। ছিলেন সিঙ্গাপুর যুবলীগের নেতারাও। মেরিনার পাশেই ৫২তলা জাহাজ বিল্ডিংয়ে (সিসিন বিল্ডিং) রাত্রিযাপন করে বাংলদেশে চলে আসেন তারা। সিসিন বিল্ডিংয়ে সম্রাটের ভিআইপি একটি স্যুট রয়েছে। স্যুটটি দেখাশুনা করেন তার স্ত্রী চিনলি।

সরজমিন দেখা গেছে, ক্যাসিনো বোর্ডের প্রতিটি টেবিলে রোবট ঘুরে ঘুরে জুয়াড়িদের চা, কফি ও জুস পরিবেশন করে। যে কজন জুয়াড়ি জিতে বা হেরে ‘পাইজা চেয়ারম্যান কার্ড’ অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে সম্রাট অন্যতম। তিনি সর্বশেষ খেলেন ‘পাইজা রুমে’, যার অবস্থান মেরিনার তৃতীয় তলার ‘এক্সক্লুসিভ জোনে’।

ওই এলাকায় সাধারণ জুয়াড়িরা পা ফেলতে পারেন না। তবে একজন পাইজা মেম্বার নারী বা পুরুষ দুজন সহযোগীকে ‘স্পন্সর’ করতে পারেন। ‘মিলিয়ন ডলার খেলে’ ধাপে ধাপে অর্জন করতে হয় ‘পাইজা কার্ড’। সম্রাট সেখানে ‘পাইজা চেয়ারম্যান’ হিসেবে পরিচিত। মেরিনা ও রেস্টওয়ালে বাংলাদেশের যে সহস্রাধিক লোক তালিকাভুক্ত তাদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) তিনজন বড় কর্মকর্তা, যারা নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন। তাদের একজন গত মাসের মাঝামাঝিতে এসে ক্যাসিনোতে খেলে গেছেন।

এখানে বাংলাদেশের আরেকজন ‘বড় জুয়াড়ি’ আছেন। ‘খান ভাই’ হিসেবে পরিচিত ওই বাংলাদেশির বাড়ি চট্টগ্রামে, তার বাসা আছে রাজধানী ঢাকার গুলশানেও। তিনি সিঙ্গাপুরেই থাকেন; মাঝেমধ্যে দেশে আসেন। মোহাম্মদপুরের জাতীয় পার্টির নেতা সফিকুল ইসলাম সেন্টুও সেখানকার বড় জুয়াড়ি হিসেবে পরিচিত।

এছাড়া স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি (সম্প্রতি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়া) মোল্লা মোহাম্মদ আবু কাউছার, সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য পংকজ দেবনাথ, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি (দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়া) ওমর ফারুক চৌধুরী, সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, নুরুন নবী চৌধুরী শাওন, কাউন্সিলর (স¤প্রতি অপসারিত) মোমিনুল হক সাঈদ, কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান ওরফে পাগলা মিজান, কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজিব, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের প্রধান নির্বাহী লোকমান হোসেন, রূপগঞ্জ ক্লাবের মালিক লুৎফর রহমান বাদল, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এস এম রবিউল ইসলাম সোহেল, চাঁদপুরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মমিনুর হক, ফেনীর সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী এবং সরকারদলীয় হুইপ শামসুল হক চৌধুরী এখানে বড় জুয়াড়ি হিসেবে পরিচিত।

মেরিনা বে ক্যাসিনোতে আরও দেখা যায়, নিচতলায় আছে দেড় শতাধিক ক্যাসিনো বোর্ড। সেখানে ক্যাসিনো খেলছেন এমন কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা নিজেদের যশোরের ইব্রাহিম, গাজীপুরের সোহেল রানা, কুমিল্লার ফরিদ উদ্দিন, ঢাকার আসলাম মিয়া, ফেনীর রতন ব্যাপারী, ফরিদপুরের ইব্রাহিম, ঝিনাইদহের সোহেল, মুন্সীগঞ্জের মহসিন, চাঁদপুরের শহীদ বলে নিজেদের পরিচয় দেন। তারা জানান, বেশ কয়েক বছর ধরে তারা ক্যাসিনোতে খেলছেন।

প্রথম অবস্থায় লাভ পাওয়া যায়। পরে আর লাভ দেখা যায় না। যশোরের ইব্রাহিম দেশ রূপান্তরকে জানান, ১০ বছর ধরে সিঙ্গাপুরের বুগিছ এলাকায় একটি ফ্যাক্টরিতে চাকরি করছেন। মাসে এক লাখ টাকার ওপরে বেতন পান। তিনি বলেন, ‘মেরিনা ও রেস্টওয়ালে দীর্ঘদিন খেলছি। প্রথম অবস্থায় লাভ পেয়েছি। যেদিন প্রথম ক্যাসিনোতে অংশ নিই সেদিন প্রায় ৩০ হাজার ডলার লাভ করি। সেই লোভ থেকেই খেলে আসছি। কিন্তু কোনো লাভ পাচ্ছি না। প্রতিনিয়ত লোকসান হচ্ছে। লাভের আশায় খেলেই যাচ্ছি। আজও (২০ অক্টোবর) ২০ হাজার ডলার শেষ করে ফেলেছি।

এখন প্রায় নিঃস্ব। বাড়িতে কোনো টাকা পাঠাতে পারছি না। একটি গাড়ি ছিল তাও বিক্রি করে দিয়েছি। আমার পরিচিত একজন একটি বাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছেন।’ বেশিরভাগ জুয়াড়িই লাভের মুখ দেখেন কম বলেও জানান তিনি।

গাজীপুরের সোহেল জানান, ২ বছর ধরে তিনি ক্যাসিনো খেলছেন। প্রথম ৩ মাস লোকসানের দিকে ছিলেন। অন্তত ৫০ হাজার ডলার লোকসানে ছিলেন। বর্তমানে তিনি লাভে আছেন। গতকালও (২০ অক্টোবর) ২০ হাজার ডলার লাভ করেছেন। সোহেল বলেন, বাংলাদেশের বড় বড় মাফিয়ারা এখানে এসে খেলাধুলা করে থাকেন। টেনশন ছাড়া খেললেই লাভের মুখ দেখা যায়। বাংলাদেশে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় কিছুদিন জুয়াড়িদের আনাগোনা কমে গিয়েছিল। এখন আবার তুঙ্গে।

সিঙ্গাপুরের আইন অনুযায়ী বিদেশি শ্রমিক বা কর্মী যারা পিআর কার্ড পাননি তাদের ক্যাসিনোতে খেলতে কোনো ট্যাক্স দিতে হচ্ছে না। আর সিঙ্গাপুরের নাগরিকদের ক্যাসিনোতে নিরুৎসাহিত করতে সরকার নাগরিক বা পিআরদের ক্যাসিনোতে প্রবেশে ২৪ ঘণ্টায় দেড়শ ডলার ট্যাক্স বসিয়ে রেখেছে। তাছাড়া তাদের নানা রকমের জবাবদিহি করতে হয়। ঝিনাদহের সোহেল  জানান, ক্যাসিনোর সামনে ৫টি ব্যাংকের বুথ আছে। হেরে গেলেই জুয়াড়িরা বুথে গিয়ে আবার ডলার নিয়ে আসেন।

সেন্তুসা রেস্টওয়ালে দেখা গেছে, বাংলাদেশের দ্ইু দম্পতি ‘ব্যাংকার প্লোয়ার’ খেলছেন। চারজনের চোখ ক্যারামের দিকে। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে এক পলকেই চেয়ে আছেন তারা। সেদিন তারা ২৯ হাজার ডলার খুইয়েছেন। তারা সিঙ্গাপুরেই থাকেন; মাঝেমধ্যে দেশে আসেন। প্রথমে তারা এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে চাননি। অনেক অনুরোধের পর একজন বলেন, ‘আমরা সম্র্রাট ভাইকে চিনি। এখানে বাংলাদেশ থেকে অনেক রথী-মহারথী খেলতে আসেন। বাদল গ্রæপ ও সম্রাট গ্রপের লোকজনই এখানে বেশি জনপ্রিয়।

ক্যাসিনো কর্তৃপক্ষ খুবই সচেতন। জুয়ায় কেউ হেরে গিয়ে পাগলামি করলে তার মেম্বারশিপ কার্ড বাতিল হয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘সম্রাটের খেলার ধরন ভিন্ন। তিনি লস খুব কম করেন। তার খেলা দেখেই এই পথে পা বাড়াই। মাঝখানে বেশ লাভ করেছিলাম। এখন লসের দিকে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ক্যাসিনোর তালিকায় অন্তত সহস্রাধিক বাংলাদেশির নাম আছে।

এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।’ রমজান ব্যাপারী নামে এক শ্রমিক জানান, লোভ সামলাতে পারেননি তিনি। মুহূর্তের মধ্যে ফতুর হতে হয়। তিনি বলেন, ‘এই দেশে যা ইনকাম করেছি সব শেষ করে দিয়েছি ক্যাসিনোতে। লোকসানের ক্ষতি পোষানোর জন্যই এখানে আসতে হচ্ছে। কিন্তু লাভ আর হচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘দিনের বেলায় কাজ করি। আর রাতে ক্যাসিনোতে অংশ নিই। বাংলাদেশে থাকা স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে নিয়মিত কথাও বলতে পারি না।’