সিঙ্গাপুরে ভালো নেই বাংলাদেশের শ্রমিকরা

সিঙ্গাপুরের বুগিছ এলাকার একটি জাহাজ ফ্যাক্টরিতে প্রায় ১০ বছর ধরে কাজ কারছেন বাংলাদেশের মোহাম্মদ রুহুল আমিন। বেতন পান মাসে ৭০০ ডলার (৪৪১০০ টাকা)। থাকা-খাওয়াসহ খরচ পড়ে প্রায় ২৫ হাজার টাকা। বাকি টাকা গ্রামের বাড়ি জামালপুরে পাঠাতে হয় তাকে। দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘যে বেতন পাই তা দিয়ে সিঙ্গাপুরে অনেক কষ্টে থাকতে হচ্ছে। বাড়িতে যে টাকা পাঠাই তা দিয়ে সংসার চলে না।’ রুহুল আমিনের মতো আরেক বাংলাদেশি গাজীপুরের রোস্তম ফরাজী মোস্তফা সেন্টারের পাশেই মোহাম্মদীয়া হোটেলে চাকরি করেন। তিনি বলেন, ‘যে আশা নিয়ে সিঙ্গাপুর এসেছি তা পূরণ হচ্ছে না। অনেক কষ্ট করে চলতে হচ্ছে। সিঙ্গাপুর আসতে প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। গত তিন বছরেও এ টাকা ওঠাতে পারিনি।’
রুহুল আমিন ও রোস্তম ফরাজীর মতো অধিকাংশ বাংলাদেশি শ্রমিকই নানা সমস্যার মধ্যে দিনযাপন করছেন সিঙ্গাপুরে। দেশটির বিভিন্ন এলাকার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এই চিত্র পাওয়া গেছে। দেশ রূপান্তরের কাছে অভিযোগ করে তারা জানান, সিঙ্গাপুরে এভাবে দিনের পর দিন কষ্ট করে দেশে ফেরার যাত্রাও স্বিস্তদায়ক হয় না। চাঙ্গি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। হয়রানির শিকার হতে হয় বাংলাদেশের বিমানবন্দরেও।
প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভাগ্য বদলের স্বপ্নে বিভোর হয়ে সিঙ্গাপুর পাড়ি জমানো বাংলাদেশি শ্রমিকরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন। এতে কারও কারও ভাগ্য খুললেও স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে বেশিরভাগ শ্রমিকেরই। আবার কষ্টের টাকায় পরিবারের জন্য স্বর্ণালঙ্কারসহ উপহারসামগ্রী কিনে বাড়ি আনতে গিয়ে হয়রানি ও ভোগান্তিতে পড়া তাদের কাছে নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। শখ করে একটু বেশি মালামাল কিনে রওনা হওয়ার পর চাঙ্গি বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন ওইসব মালামাল আটকে দেয়। আবার নিজ দেশের বিমানবন্দরেও নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়।
গত ২০ ও ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরের বুগিছ, উত্তম পার্ক, মোস্তফা সেন্টারের আশপাশ এলাকা, তোয়াজ লিং, সিটি হল ও চাঙ্গি এলাকায় অন্তত শতাধিক শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। সবারই একই কথা– সিঙ্গাপুর উন্নত দেশ। কিন্তু এখানের আইন খুবই কড়া। বেতন কম। কোনো কোম্পানির একই পদে চাকরি করলেও সিঙ্গাপুরের নাগরিকরা বেশি সুবিধা পান। এক শ্রমিক আক্ষেপ করে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ওদের আমাদের চেয়ে বেশি বেতন দেয় কোম্পানি। অথচ ওরা একই সমান কাজ করে। তাছাড়া বাংলাদেশের যেসব দালাল আছে তাদের বেশিরভাগই প্রতারক। ভালো কাজ করার কথা বলে তারা শ্রমিকদের দেশের বাইরে পাঠায়। অথচ কাজ দেয় নিম্নমানের। শ্রমিকরা কারও কাছে অভিযোগ করতে পারে না।’
মোস্তফা সেন্টারের আশপাশের রোবাটস লেন, সৈয়দ আলওয়ি রোড, রয়েল রোড, কেজি কাপুর রোড, সিরাংগং এলাকা ছাড়াও ডরমেটরি সিস্টেমে পগগুল, তোয়াজ ফাইভ স্টার, তোরাজ ভিউ, কেরেনভি, লেক সাইডসহ কয়েকটি এলাকায় বাংলাদেশি প্রবাসীদের বসবাস বেশি। বেশিরভাগ শ্রমিক সেখানে অস্থায়ীভাবে বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন। নির্মাণশিল্প, জাহাজ, উৎপাদন ও সেবা খাতসহ হোটেল ও রেস্তোরাঁয় কাজের সুযোগ বেশি। লরি এবং পিকআপ চালকের চাকরিও রয়েছে। দুই বছর আগেও কাজের বাজার মন্দা ছিল বলে জানান মোহাম্মদ হানিফ, আবদুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন। তারা বলেন, সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশিদের কাজের কোনো গ্যারান্টি নেই। এর পেছনে কয়েকজন বাংলাদেশির কারসাজি রয়েছে। ইচ্ছে করলেই বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত করা যায়। আবার কয়েকজন বাংলাদেশির অপকর্মের দায় নিতে হয় অনেককে। এছাড়া নানা হয়রানি তো আছেই। তবে বেশ কয়েকজন শ্রমিক জানান, ঠিকমতো কাজ করলে মাসে ৪৫-৫০ হাজার টাকা দেশে পাঠানো যায়। অনেকে ৬০-৮০ হাজার টাকাও পাঠাতে পারেন। অবশ্য যারা ক্যাসিনোতে আসা-যাওয়া করেন তাদের টাকাই থাকে না।
যশোরের কুদ্দুস রানা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বছরখানেক আগে ১২ লাখ টাকা খরচ করে সিঙ্গাপুরে এসেছি। একটি কনফেকশনারি দোকানে চাকরির কথা ছিল। মাসে বেতন দেওয়ার কথা ছিল ১৫০০ সিঙ্গাপুরি ডলার। কিন্তু এখানে আসার পর দেখি– একটি খাবার হোটেলে চাকরি হয়েছে। বেতন পাচ্ছি ৬৫০ ডলার। থাকা ও খাওয়ার খরচের পর আর কত টাকা থাকে আপনিই বলেন? পরিবারের কথা চিন্তা করে কাজ করেই যাচ্ছি।’ কুমিল্লার মিজান বলেন, ‘অনেক কষ্ট হচ্ছে। ভালো কোম্পানিতে চাকরি দেওয়ার কথা বলে দালাল সিঙ্গাপুরে পাঠিয়েছে। ভালো কোম্পানি দূরের কথা, ছোট একটি খাবার হোটেলে কাজ করছি। বেতন মাত্র ৬০০ ডলার। তবে মালিক বলেছেন, ডিসেম্বরে ২০০ ডলার বাড়াবেন। দেখি ভাগ্যে কী লেখা থাকে। দালালকে ফোন করলে সে আর ফোন ধরে না।’
সিঙ্গাপুরের এক পুলিশ অফিসার দেশ রূপান্তরকে জানান, সেখানে বিদেশি শ্রমিকদের মধ্যে বাংলাদেশের শ্রমিক বেশি। তারা সিঙ্গাপুরের আইনকানুন কম বোঝে। ট্রাফিক আইন বোঝেই না বলে চলে। মাঝেমধ্যে জরিমানা করা হয়। তবে বাংলাদেশিরা বেশ কর্মঠ। ভালো করে কাজ করলে টাকা আয় করতে পারে বেশি। শ্রমিকদের মধ্যে কিছু জুয়া খেলে। তিনি আরও জানান, সিঙ্গাপুরের অনেক ভালো কোম্পানি আছে। সেখানে চাকরি করলে ভালো বেতন পাওয়া যায়। তবে বাংলাদেশের বেশিরভাগ শ্রমিক হোটেল বা দোকানে কাজ করে।
মোস্তফা সেন্টারের সামনের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশন কোনো শ্রমিকের খোঁজখবর নেয় না। আর আমরা হাইকমিশনের ধারেকাছেও যেতে পারি না। বেশিরভাগ শ্রমিকই কষ্টে আছেন সিঙ্গাপুরে। প্রতি শনি ও রবিবার মোস্তফা সেন্টারের সামনে এলেই বোঝা যায় শ্রমিকরা কত কষ্টে আছেন। এই দুদিন বিভিন্ন স্থান থেকে বাংলাদেশিরা এসে জড়ো হন মোস্তফা সেন্টারের সামনে।