ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ৮ই মে ২০২৫, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩২


ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর

রাজাকারের ছেলে সাইদুলের কাছে জিম্মি কামরাঙ্গীরচরের ৪ লাখ মানুষ


১ নভেম্বর ২০১৯ ২১:১৭

আপডেট:
১ নভেম্বর ২০১৯ ২১:২২

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কামরাঙ্গীরচরে ‘হাফেজ্জি হুজুরের’ মাদ্রাসায় পাকিস্তান সেনা ক্যাম্পে বাবুর্চির কাজ করতেন আবদুল জলিল। মুসলিম লীগ সমর্থক জলিল তখন থেকেই এলাকার মানুষের কাছে ‘রাজাকার’ হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতার পর সেই জলিলই এলাকায় নিজের পরিচয় দিতেন ‘মাদবর’ হিসেবে। তার ছেলে সাইদুল ইসলাম মাদবর এখন কামরাঙ্গীরচর থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

আর হাজি সাইদুল ইসলাম (মাদবর) নামে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তিনি। সাইদুল ছাড়া ‘রাজাকার’ জলিল পরিবারের ১৪ জন এখন কামরাঙ্গীরচর থানা ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা। এসব কথা জানিয়েছেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সুলতানগঞ্জ ইউনিয়ন (বর্তমান কামরাঙ্গীরচর) ছাত্রলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম।

একই রকম বক্তব্য দিয়েছেন আবদুর রহিমসহ স্থানীয় কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে সাইদুল কাউন্সিলর  বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে একটি মহল কুৎসা রটনা করছে। আমার বাবা এলাকায় অনেক মসজিদ-মাদ্রাসা করেছেন। তিনি এলাকায় বেশ সম্মানিত লোক ছিলেন। আমার বাবা আমাদের যা দিয়ে গেছেন, তাই নিয়ে আমরা ভালো আছি।’

স্থানীয়দের অভিযোগ, সেই ‘রাজাকার’ পরিবারের কাছেই এখন জিম্মি ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের চার লাখ বাসিন্দা। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। খাসজমি, খেয়াঘাট, সাধারণ মানুষের বাড়িঘর দখলসহ সবকিছুই চলে এই ‘মাদবর’ পরিবারের নিয়ন্ত্রণে। কোনো বাড়ি করতে গেলে তাদের চাঁদা দিতে হয়। সাইদুল মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন। নানা ধরনের নারী নির্যাতনের অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ওয়ার্ডের আশ্রাফাবাদ, মাদ্রাসাপাড়া, মমিনবাগ, আহসানবাগ, পাকাপুল, ইসলাম নগর, দুখুরিয়া, মাদবর বাজার, নুরবাগ, কুমিল্লাপাড়া, রহমতবাগ, নিজামবাগ, বাগচান খাঁ পশ্চিমাংশ, বাগচান খাঁ পূর্বাংশ, ইব্রাহীম নগর, বালুরমাঠ, করিমাবাদ, হাসলাই ও মুসলিমবাগসহ আশপাশের মানুষের সঙ্গে ‘জমিদার আর প্রজার’ মতো আচরণ করেন সাইদুল মাদবর।

স্থানীয়রা জানায়, কাউন্সিলর সাইদুলের ব্যক্তিগত কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য বা বৈধ আয়ের উৎস নেই। মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ, দখল আর চাঁদাবাজিই তার আয়ের উৎস। রাষ্ট্রীয় কোনো দিবস বা উপলক্ষ যেন সাইদুলের কাছে আশীর্বাদ। সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন কর্মসূচি, বনভোজন, নৌকাবাইচের নামে প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেন সাইদুল। ওয়ার্ড এলাকার প্লাস্টিক পণ্য ব্যবসায়ী, ছোট-বড় কারখানা, আমদানি-রপ্তানিকারক, খাবারের দোকান, বিভিন্ন শোরুম, কারখানার মালিক, ব্যবসায়ী সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে তাকে চাঁদা দিতে হয়। এতে সহযোগিতা করেন তার আত্মীয় মনির মাদবর, মিলন মাদবর ও মিজানসহ কয়েকজন।

সাইদুলের উত্থান সম্পর্কে এলাকাবাসী জানায়, আবদুল জলিলের অষ্টম সন্তান কাউন্সিলর সাইদুল। তিনি কখনো আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না। সৌদি আরবে একটি হোটেলে বাবুর্চির কাজ করে ২০০৯ সালে দেশে ফিরে সৎভাই সোলেমানের হাত ধরে আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিংয়ে যাওয়া শুরু করেন। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতাকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে কামরাঙ্গীরচর থানা আওয়ামী লীগের বিতর্কিত কমিটিতে যুগ্ম সম্পাদক পদ পান। পরে সাবেক এক মন্ত্রীর আশীর্বাদে আওয়ামী লীগের হয়ে কাউন্সিলর মনোনয়ন পেয়ে কেন্দ্র দখলের মাধ্যমে কাউন্সিলর হন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজনীতিতে অভিজ্ঞতা না থাকলেও দখলবাণিজ্যে সিদ্ধহস্ত সাইদুল কাউন্সিলর। তিনি নির্বাচিত হওয়ার পরপরই থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেনের বালু ভরাটের কাজ দখল নিতে ট্রলার ভাঙচুর করান। পরে তাকে হটিয়ে ম্যাটাডোর কোম্পানির ওই মাটি ভরাটের কাজ করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। তার কিছুদিন পর জাতীয় পার্টির নেতা হাজি মাহবুবের একটি মার্কেট দখল করতে যায় তার বাহিনী। দখল করতে না পেরে শিপন ও দাদনের নেতৃত্বে মার্কেটে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। ওই ঘটনায় সাইদুলের বিরুদ্ধে মামলা হলে কিছুদিন আত্মগোপনে থাকেন তিনি।

স্থানীয়দের অভিযোগ, কামরাঙ্গীরচরের ১ একর ৬০ শতাংশের সরকারি একটি ডোবা দখলের পর ভরাট করে প্লট আকারে বিক্রি করেছেন সাইদুল। তার নেতৃত্বে সোলায়মান, দাদন, শাহআলম, শিপনসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি সিন্ডিকেট করে ওই জমি বেচে প্রায় ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এছাড়া সাইদুল কাউন্সিলর ও তার পরিবারের বিশাল সিন্ডিকেট বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলে সিএস ১১৮১ দাগের খাসজমি দখল করে জনৈক এমপির কাছে বায়না করেছেন। এর আগে একাধিক সাংবাদিক সংগঠন ওই জমি লিজ নেওয়ার চেষ্টা করে। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় নতুন কোনো স্থাপনা তৈরি, গ্যাস বা বিদ্যুতের সংযোগ নিতে গেলেও সাইদুল বাহিনীকে চাঁদা দিতে হয়। অস্বীকৃতি জানালে চলে নির্যাতন। চাঁদা না পেয়ে সম্প্রতি মাদবর বাজারের বিল্লাল মার্কেট ও শরীয়তপুরপাড়া হলে হামলা করে কাউন্সিলরের বাহিনী।

স্থানীয়দের অভিযোগ, সাইদুলের খুঁটি তার বড়ভাই সোলায়মান। একসময় নৌ-ডাকাত দলে যুক্ত সোলায়মান সুলতানগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন তিনি থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তার নিয়ন্ত্রণে চলে মাদবর বাজার, মুসলিমবাগ এবং কয়লাঘাটের ট্রলার ও খেয়াঘাট। সোলেমানের বিরুদ্ধে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে শিশুদের অঙ্গহানি করে ভিক্ষাবৃত্তি করানো ও তরুণীদের বাধ্যতামূলকভাবে পতিতাবৃত্তিতে নামানোর অভিযোগে মামলা করে র‌্যাব। ওই সময় বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে সে খবর সোলেমান মাদবরের ছবিসহ প্রকাশিত হয়। বর্তমানে ওই মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিনে আছেন সোলায়মান। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সোলায়মান দেশ রূপান্তরকে বলেন, তিনি খেয়াঘাট ইজারা নিয়ে পরিচালনা করেন। কিছুদিন আগে ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হোসেনের লোকজন তার খেয়াঘাট বন্ধ করে দেয়। পরে তিনি ফের চালু করেন। শিশুদের অঙ্গহানি করে ভিক্ষাবৃত্তির অভিযোগের মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একটি ভুল বোঝাবুঝি থেকে আমার নাম এসেছে।’

সাইদুলের দখল চাঁদাবাজির বড় একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন তার এক স্বজন মনির মাদবর। ১৯৯৬ সালে কামরাঙ্গীরচরে চাঞ্চল্যকর ফুটবলার শান্ত ও ১৯৯৭ সালে রহমতবাগের হোসেন ওরফে হোসনা হত্যাকা-ে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মনির বলেন, ‘এসব মামলা এখন নেই। আমি এলাকায় কাউন্সিলর নির্বাচন করব। তাই একটি মহল আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে।’

স্থানীয়রা বলছে, বিভিন্ন স্কুলেও চলে কাউন্সিলর সাইদুলের আধিপত্য। লেখাপড়া না জানলেও আশ্রাফাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি সাইদুল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষিকা দেশ রূপান্তরকে বলেন, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ কাউন্সিলরের স্বভাব। স্কুলের ভবন নির্মাণকাজ থেকে মনির মাদবরের মাধ্যমে কয়েক লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন কাউন্সিলর। আশ্রাফাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের স্বঘোষিত সভাপতি তার বড়ভাই সোলায়মান। সেখানেও শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেন কাউন্সিলর।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাদক কারবারে সাইদুল মাদবরের সংশ্লিষ্টতা বহু পুরনো। ইয়াবা, গাঁজা ও হেরোইন সেবন এবং এসবের কারবারে যুক্ত থেকে প্রাণ হারায় তার আরেক সৎভাই খোকন মাদবর। সাইদুল পরিবারের সদস্য জসিম মাদবরকে সবাই ‘নেশাখোর জসিম’ নামে চেনে। মিলন মাদবর, ভাতিজা ড্যানি মাদবর, ভাতিজা মিতু মাদবর, দেহরক্ষী রাজু ওরফে কিলার রাজু, দশানী হানিফ, দশানী মুন্না, দশানী সাক্কু, সাইদুরের এপিএস স্বপন ও শ্যালক মিজানের মাধ্যমে ইয়াবার কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন সাইদুল।

কাউন্সিলর সাইদুলের নারী আসক্তির বিষয়টিও এলাকার মানুষের মুখে মুখে। স্থানীয়রা জানায়, ভাতিজা মশিউর রহমান মনার স্ত্রী সঙ্গে সাইদুরের ‘পরকীয়ার’ কারণে তার সংসার ভাঙে। প্রতিবাদ করলে মনাকে মামলা দিয়ে জেল খাটায় সাইদুল। মনা বলেন, ‘কাউন্সিলরের কারণে আমার সংসার নষ্ট হয়েছে, জেলে গেছি। অথচ বিচার পাইনি। ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেনের কাছেও তার নামে বিচার দিয়েছি। লাভ হয়নি।’ স্থানীয়রা জানায়, সাইদুলের সঙ্গে তার দূরসম্পর্কের ভাগ্নি জুয়েলের স্ত্রীর পরকীয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে জুয়েল ‘আত্মহত্যা’ করেন। পরে জুয়েলের স্ত্রী এলাকা ছেড়ে চলে যান।

স্থানীয়দের কয়েকজন ক্ষোভ প্রকাশ করে  বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী একটি পরিবার থেকে কীভাবে ১৪ জনেরও বেশি আওয়ামী লীগের পদ পায়? কাউন্সিলর সাইদুলের পরিবারের ১৪ জন এখন থানা ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা। তাদের মধ্যে আছেন কামরাঙ্গীরচর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোলায়মান মাদবর, সহ-সম্পাদক মিলন মাদবর, ক্রীড়া সম্পাদক শিপন মাদবর, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড্যানি মাদবর, সাংগঠনিক সম্পাদক মিতু মাদবর, সদস্য সোহাগ, সহসভাপতি দাদন মনির ওরফে জাপানি মনির, ওয়ার্ডের সাংগঠনিক সম্পাদক সালাউদ্দিন মাদবর, যুগ্ম সম্পাদক স্বপন মাদবর ও সদস্য রাজু মাদবর। ক্ষমতাসীন দলের এসব পদ থাকায় তারা বিভিন্ন অনিয়ম করছেন।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে কাউন্সিলর সাইদুল  বলেন, ‘এলাকায় ডোবা বা খাসজমি দখলের অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমি সৌদি আরব থেকে যা কামাই করেছি এবং আমার বাবা যা দিয়ে গেছেন সেগুলো অন্য মানুষ খাচ্ছে। ডোবা বা খাসজমি আমাদের দখলের প্রয়োজন নেই। আমি বা আমার পরিবারের কেউ চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতনসহ অন্য কোনো অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত নই। আমরা নিজের পয়সায় এলাকার মানুষের সেবা করি। আমাদের বিরুদ্ধে কেউ যদি কোনো কথা বলে থাকে তার সবই ষড়যন্ত্র।’