অনুপ্রবেশকারী দেড় হাজার
বিতর্কিত প্রায় ৪ হাজার এবং মন্ত্রী-এমপি আশ্রয়দাতাসহ তালিকায় ৬৭

ডিসেম্বরে দলের কাউন্সিলকে ঘিরে এবার তৃণমূল আওয়ামী লীগে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে। কমিটিতে যেন কোনোভাবেই বিতর্কিত এবং অনুপ্রবেশকারীরা স্থান না পায় সেই উদ্দেশ্যে আজ থেকেই অভিযানে যাচ্ছে দলটি। এ লক্ষ্যে কেন্দ্র থেকে বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা পাঠানো হয়েছে জেলায়। গতকাল শুক্রবার দলের দপ্তর সম্পাদক আট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের কাছে এ তালিকা হস্তান্তর করেন বলে দলীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।
আওয়ামী লীগের দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতা বলেছেন, দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ তালিকা দিয়েছেন। চাঁদাবাজিসহ স্থানীয় পর্যায়ে এসব বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারী নেতাকর্মীর আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা নেতাদের তালিকা দলীয় সভাপতি নিজের কাছেই রেখেছেন। এর মধ্যে মন্ত্রী, এমপি, কেন্দ্রীয় ও জেলাপর্যায়ের ৬৭ নেতার নাম রয়েছে। তারা আগামী সম্মেলনে কোনো পদ পাবেন না।
আওয়ামী লীগের এক প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গণভবনে দলের গত কয়েকটি বৈঠকে সভানেত্রী দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে তৃণমূলের তালিকা চেয়েও না পেয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি গত বৈঠকে বলেছেন, ‘আপনারা তালিকা না দিলেও আমার কাছে তালিকা রয়েছে। ক্ষমতার সুযোগে যেসব এমপি স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় নেতাকর্মীদের উপেক্ষা করে অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে অপকর্মে জড়িয়েছেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ছাড়া যেসব এমপি জেলায় দলীয় দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন তাদের প্রতিও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তিনি। শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন, একই ব্যক্তি দল ও সরকারের দায়িত্ব নেবেন তা তো হয় না। এবার তৃণমূলে রাজনীতিকদেরই স্থান দেওয়া হবে। মন্ত্রী, এমপিদেরও সেরকমই ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার শেখ হাসিনা দলের দপ্তর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপের কাছে দুটি বই হস্তান্তর করেন। একটির মধ্যে ২০০৮ সাল থেকে বিভিন্ন
সময়ে বিএনপি ও জামায়াত থেকে দলে অনুপ্রবেশকারী দেড় হাজারের তালিকা। আরেক তালিকায় রয়েছে বিতর্কিতদের নাম। তিনি বই দুটি হস্তান্তরের সময় বলেছেন, এদের বিরুদ্ধে দলীয় সিদ্ধান্ত যেন দ্রুত নেওয়া হয়। এদের মধ্যে যারা তৃণমূলের কমিটিগুলোতে পদ-পদবিতে রয়েছে তাদের কাউন্সিলের আগেই যেন বহিষ্কার করা হয়।
দলের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা জানান, ছয় মাস ধরে কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব টিম এই অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা তৈরি করে। গত বৃহস্পতিবার দলের সম্পাদকম-লীর সভায় এ তালিকা নিয়ে আলোচনা হয়। সভা শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা জেলায় জেলায় তালিকা পাঠাচ্ছি। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিতে বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীদের একটি তালিকা নেত্রী (শেখ হাসিনা) বিভিন্ন সংস্থাকে দিয়ে তৈরি করেছেন। সে তালিকা তিনি দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাঠিয়েছেন। বিতর্কিত কেউ যাতে বিভিন্ন পর্যায়ের সম্মেলনে কমিটিতে স্থান করে নিতে না পারে, সেজন্য আমরা সতর্ক রয়েছি। নেতাকর্মীদের সেভাবেই দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে।’
গতকাল বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের তালিকা দেওয়া হয়। রংপুর, বরিশাল, সিলেটসহ বিভিন্ন বিভাগের অনুপ্রবেশকারীদের তালিকায় দেখা যায়, অনেকেই আওয়ামী লীগের জেলা-মহানগর, উপজেলা-থানা, ইউনিয়ন কমিটির পদ-পদবিতে আছেন।
রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক বলেন, ইতিমধ্যে অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিতদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে। গত মাসে রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় একটি ওয়ার্ডের সভাপতির ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি এবং তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, বিতর্কিত এবং অনুপ্রবেশকারী কোনো ব্যক্তির কাউন্সিলে ঠাঁই নেই। তাদের শুধু কেন্দ্রীয় সম্মেলনই নয়, সহযোগী সংগঠনেও রাখা হবে না।
সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, তালিকা অনুযায়ী আমরা কাজ শুরু করব। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে তারা দলীয় পদ-পদবিতে থাকতে পারবেন না। আগামীতেও কেউ আওয়ামী লীগ বা সহযোগী সংগঠনের পদে আসতে পারবেন না।
রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের দায়িত্বে থাকা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, দলীয় সভানেত্রীর নিজস্ব টিম এবং একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার করা তালিকা আমাদের হাতে। এখন থেকেই কাজ শুরু হচ্ছে।
অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গে দলের একাধিক নেতা বলেন, ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের পর থেকেই বিষয়টি ঘটতে থাকে। এরপর দ্বিতীয় মেয়াদের এমপিরা এলাকায় নিজেদের একক কর্তৃত্বের জন্য এবং দল ভারী করতে দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ করা নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে বিএনপি ও জামায়াত-শিবির নেতাদের দলে টেনেছেন বলে গোয়েন্দা সংস্থা ও শেখ হাসিনার নিজস্ব টিমের করা প্রতিবেদনে ধরা পড়ে।
একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর অনুপ্রবেশ বেশি হয়েছে এবং স্থানীয় পর্যায়ে বিশৃঙ্খলা বাড়ে। বিশেষ করে ২০১৩, ’১৪ ও ’১৫ সালের আগুনসন্ত্রাস, পেট্রলবোমায় মানুষ হত্যাসহ আন্দোলনের নামে সহিংসতার সঙ্গে জড়িত বিএনপি-জামায়াতের অনেক নেতা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে জেলা-উপজেলা, ইউনিয়নের পদ-পদবি পেয়ে যান।
জানা গেছে, গত এক বছর ধরে দলের তৃণমূল থেকে অনুপ্রবেশ এবং দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে কয়েকটি ঘটনার পর গত ৫ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী ও বিতর্কিতদের তালিকা করার নির্দেশ দেন দলীয় সভানেত্রী। এরপর তিনি নিজেই টিম গঠন করেন।
গতকাল রংপুর ও বরিশাল বিভাগের অনুপ্রবেশকারীদের নাম-ঠিকানাসহ তালিকা পাওয়া গেছে। রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলায় গত কয়েক বছরে ৩৮৯ জন অনুপ্রবেশ করেছে। তাদের মধ্য বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী রয়েছে। এর মধ্যে রংপুর জেলায় রয়েছে ২২, দিনাজপুরে ১১৫, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৩০, নীলফামারীতে ১৩ এবং লালমনিরহাটে ১০৯ জন।
বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোতে ৪৩৩ জন অনুপ্রবেশকারী নাম, ঠিকানা, পরিচয় ও আগের দলের তথ্য তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে বরিশাল জেলায় রয়েছেন ২৩১, ভোলায় ১৩৬, পটুয়াখালীতে ২৫, ঝালকাঠিতে ১৫, পিরোজপুরে ১০, বরগুনায় ১০ ও বরিশাল মহানগরে ৬ জন।
রংপুর জেলা : মোশাররফ হোসেন, মো. আবদুর রউফ, মো. সমতুল্লাহ, আবদুর রহিম, মো. আবদার হোসেন, কল্পনা বেগম, আল আমীন, হারুন মিয়া, রাজা মিয়া, আবু বক্কর সিদ্দিক, মোয়াজ্জেম হোসেন, আয়শা বেগম, শফিকুল ইসলাম, জুলেখা বেগম, রফিকুল ইসলাম, আউয়াল মেকার, সোলেমান আলী, দুলাল মেম্বার, কেরামত আলী, আবদুল হাই, আবদুর রহিম, আবুল কালাম আযাদ।
ঠাকুরগাঁও জেলা : আবদুর আজিজ, রোমান বাদশা, কামরুজ্জামান টিটু, রাশেদুল ইসলাম, নাসিরুল হক, রুহুল আমিন, তফিলউদ্দিন, মিজানুর রহমান, মাহাবুব, সোলেমান আলী, শাহাদাত হোসেন, তসলিম উদ্দিন, আবদুল গফুর, হুরুল আমিন, আবদুর রহমান, বসিরউদ্দিন, অ্যাডভোকেট আবু হাসান, শরীফ উদ্দীন, ইউসুফ আলী, রশিদুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম, দবির, ফারাজুল ইসলাম, আফসার আলী, বলজার রহমান, আ. কাদের, আনোয়ার হোসেন, আবদুর গফুর, জালাল উদ্দীন, আবদুল গাফ্ফার, সোলেমান হোসেন, মতিয়ার রহমান, রেজাউল হক, আল মামুন, আবদুল হক, সাইফুল হক, আজিজুল রহমান।
দিনাজপুর : মজিবুর রহমান, আমিনুল ইসলাম, জিল্লুর রহমান, মহসীন আলী, সামছুল হক, হুমায়ূন, বকুল মণ্ডল, নূর ইসলাম, হাবিবুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম, মেহেরুল ইসলাম, আয়্যুব আলী, আকবর আলী, ইকবাল হোসেন, মানিক মাস্টার, আক্তার মণ্ডল, মোখলেছুর, সিরাজুল ইসলাম, বাবলু সরদার, আমিনুল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাক, শহিদুজ্জামান শাহ নুর ইসলাম, রফিকউদ্দিন, নুর ইসলাম, আবদুল মুজিদ, রশিদুল ইসলাম শাহ, মোরশেদুল হক, হাসান আলী, জাহাঙ্গীর আল চৌধুরী, কাইয়ুম উদ্দিন, মেরিনা বেগম, মালেকা খাতুন, আলতাফ হোসেন, আবদুস সালাম, জহুরুল হক, বেবি বেগম, খোরশেদ আলম, আবুল কাশেম মণ্ডল, নজরুল ইসলাম, আবদুল্লাহ, কাশেম আলী, আরিফুল, আজিজুল, তরিকুল ইসলাম, আজিজ মিয়া, আকরাম হোসেন, আবদুল মালেক, সায়মুন নবী চৌধুরী বাদল, নুর আলম, রবিউল ইসলাম চৌধুরী, মাসুদ জাহাঙ্গীর, জহিরুল ইসলাম, জাকিরুল, কাউসার আলী, আনিছুর রহমান, মুমিন, শফিউল ইসলাম, মাহফুজুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, সিরাজুল ইসলাম, শহীদুল ইসলাম, শামসুল আলম, আবদুর রহিম মিয়া, আবদুর রউফ, আতিকুর রহমান, আবু তাহের মৃধা, আলহাজ মোহাম্মদ ইজাজ আহমেদ সোনা, আকিল আহমেদ, মুজিবর রহমান, মহিউদ্দিন আহমেদ, আনজুমারা বেগম, হারুনুর রশিদ, আতাউর রহমান।