ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ৮ই মে ২০২৫, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩২


তদন্ত কমিটি হলেও রিপোর্ট আলোর মুখ দেখে না

‘নিরাপদ বাহন’ট্রেন অনিয়মের কারনেই বাড়ছে দুর্ঘটনা


১৩ নভেম্বর ২০১৯ ১৫:৫৮

আপডেট:
৮ মে ২০২৫ ২২:২৭

রেলকে ‘নিরাপদ বাহন’ হিসেবে মনে করা হলেও নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশে আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে রেল দুর্ঘটনা। গত ১১ বছরে ৪ হাজার ৮০০ বার ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গেছে অন্তত ৪২৫ জন। এজন্য রেলওয়ের প্রকৌশলী ও কর্মীদের রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রমে অবহেলা ও অনিয়মকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পরিসংখ্যান বলছে, রেলের এই দুর্ঘটনার ৮২ শতাংশই ঘটছে লাইনচ্যুতি ও লেভেল ক্রসিংয়ে। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ লাইন ও সেতুর কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিদিন তিনবার করে পুরো রেললাইন, সিগন্যাল ও সেতু পরিদর্শনের নিয়ম থাকলেও অনেক সময় বছরে একবারও পরিদর্শনে যাওয়া হয় না। দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ, লাইনচ্যুত ও লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ছাড়াও অবহেলায় ট্রেনে কাটা পড়ে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয় প্রতিবছর। সর্বশেষ মঙ্গলবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৬ জন নিহত হয়। এর আগে গত ২৩ জুন মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে। উপজেলার বরমচাল রেলক্রসিং এলাকায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেসের চারটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে খালে ছিটকে পড়লে ছয়জন নিহত হয়।

রেলওয়ের এক প্রকৌশলী জানান, বড় ও মাঝারি দুর্ঘটনায় দুটি করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও কমিটির কোনো রিপোর্টই বাস্তবায়ন হয় না। শুধু তদন্ত কমিটি গঠন ও সাময়িক বরখাস্তেই শেষ হয় দুর্ঘটনা। লোকবল স্বল্পতার কারণে বরখাস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কিছু দিন পরই পুনর্বহাল করতে হয়।

রেলওয়ের একাধিক প্রকৌশলী জানান, রেলের লাইন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রেলপথে পর্যাপ্ত পাথর থাকবে এবং কোনো অবস্থাতেই একটি সি্লপারও ক্লিপ কিংবা হুকবিহীন থাকবে না। কিন্তু স্বাধীনতার পর রেলপথ পাথরশূন্য হতে শুরু করে। সিøপার নড়বড়ে, এর সঙ্গে ক্লিপ-হুক ও ফিসপ্লেট খোলার হার বেড়েই চলেছে। এখন খুবই নিম্নমানের পাথর দেওয়া হয়। প্রভাবশালী ঠিকাদারদের হস্তক্ষেপ থাকায় এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কেউ কথাও বলতে পারে না। প্রায় দুই কিলোমিটার পরপর রেলপথ দেখভাল করে গ্যাং নামে রেলের কর্মী বাহিনী। কিম্যান, ওয়েম্যান ও গ্যাংম্যানদের রেলপথ নিয়মিত পাহারা দেওয়ার কথা। কিম্যান রেলপথের এক পাশ দিয়ে একবার হেঁটে অন্য পাশ দিয়ে ফিরে আসে। তাতে নাটবল্টু, ক্লিপ ও ফিসপ্লেট ঠিকঠাক আছে কি না ধরা পড়ে। নুড়িপাথর না থাকলে ঊর্ধ্বতনদের জানানোর দায়িত্ব ওয়েম্যানদের। কিন্তু কিম্যান ও ওয়েম্যানের কাজের সমন্বয়কারী গ্যাংম্যানদের মাঠে পাওয়া যায় না বলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন সময় অভিযোগ এসেছে। এছাড়া ট্রেনের শিডিউল ঠিক রাখতে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই ট্রেন দ্রুতগতিতে চালানোর কারণেও ঘটে দুর্ঘটনা। এতে যাত্রী হতাহত হওয়া ছাড়াও রেলের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। ট্রেন দুর্ঘটনায় রেলওয়ের প্রকৌশলী ও কর্মকর্তারাও উদ্বিগ্ন। তারা বলছেন, দুর্ঘটনা রোধে জনবল বাড়ানোর পাশাপাশি যথাযথ রেলপথ এবং নতুন ইঞ্জিন ও কোচের বিকল্প নেই।

রেলওয়ে অপারেশন বিভাগ সূত্র জানায়, লেভেলক্রসিংয়ে মৃত্যুর দায় রেলের নয়। বৈধ কিংবা অবৈধ লেভেলক্রসিং পার হতে হবে দেখেশুনে। প্রতিটি লেভেলক্রসিংয়ের পাশেই বিলবোর্ডে লেখা রয়েছে, ‘এটি অবৈধ রেল লেভেলক্রসিং, নিজ দায়িত্বে পারাপার হোন।’ পথচারী ও গাড়ি চালকরা এসব না দেখে গাড়ি নিয়ে লেভেলক্রসিং পার হতে গিয়েই পড়ে দুর্ঘটনায়। ২০০৮-১৩ সাল পর্যন্ত সারা দেশে ২৭৯৮টি ট্রেন দুর্ঘটনায় ২০৪ জন নিহত হয়েছে। বাকি দুর্ঘটনাগুলো ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত। এসব দুর্ঘটনা শুধু লাইন জরাজীর্ণের কারণে হচ্ছে এমনটি নয়, মুখোমুখি সংঘর্ষ, লাইনচ্যুতি ও লেভেলক্রসিংয়েও দুর্ঘটনা ঘটছে। তবে ট্রেন লাইনচ্যুতির ঘটনায় চালক কিংবা গার্ড দায়ী নয়। মুখোমুখি সংঘর্ষের জন্য দায়ী সিগন্যালিং। এজন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট স্টেশন মাস্টার-ম্যানেজার।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, কর্মচারীদের মূল কাজই হচ্ছে রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণ করা। অথচ প্রায় ১১ হাজার কর্মচারীর পদ শূন্য। প্রতিদিন তিনবার করে লাইন, সিগন্যাল ও ব্রিজ পরিদর্শন করা ছাড়াও ট্রেন ছাড়ার আগে ইঞ্জিন ও প্রতিটি বগির বিশেষ বিশেষ যন্ত্রাংশ ও চাকা চেক করার কথা; কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। এছাড়া ২৫ শতাংশ ট্রেনচালক ও গার্ড কাজ করছে চুক্তিভিত্তিক। ভুল করলেও তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না। অবসরে যাওয়া চালক-গার্ডের ওপরই এখন নির্ভর করছে রেল।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, অনাকাক্সিক্ষত বিভিন্ন দুর্ঘটনা এড়াতে ২০১৫ সালের জুলাই মাসে ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথ সংস্কারে পূর্বাঞ্চলে রেলক্রসিং পুনর্বাসন ও গেটকিপার নিয়োগে প্রকল্প গ্রহণ করে রেল মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের মোট ব্যয় ছিল ৮০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। চার বছর আগে এই প্রকল্পের আওতায় ৩২৮টি গুরুত্বপূর্ণ লেভেলক্রসিংয়ের পুনর্বাসন ও মানোন্নয়ন কাজ শুরু হয়। প্রকল্পটি ২০১৯ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল। অথচ নির্ধারিত সময়ের পর আরও পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও কাজের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৬৯ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় এখনও ৩২৮টি রেলক্রসিং নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়নি। এর বাইরেও অননুমোদিত ও অরক্ষিত রয়েছে এ অঞ্চলের ৮১১টি রেলক্রসিং।

লেভেলক্রসিং গেটের পুনর্বাসন ও মানোন্নয়ন প্রকল্প প্রসঙ্গে রেলওয়ের এক কর্মকর্তা জানান, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। মোট অগ্রগতি ৬৯ শতাংশ। এই প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত অস্থায়ীভাবে ১৯০ জন গেটকিপার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সূত্র আরও জানায়, রেলওয়ে অ্যাক্ট ১৮৯০ ও রেলওয়ে ম্যানুয়াল অনুসারে রেলপথ অতিক্রমকারী সড়কগুলোর ক্ষেত্রে লেভেলক্রসিং সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছ থেকে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে ক্রসিং নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করবে সংশ্লিষ্ট অন্য বিভাগগুলো; কিন্তু আজও সে ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। রেলের পশ্চিমাঞ্চলেও একই অবস্থা। লেভেলক্রসিং যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে না পারায় ও প্রয়োজনীয় গেটকিপার না থাকায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা হাবিবুল্লাহ বাহার জানান, পূর্বাঞ্চলে ৩২৮টি রেলক্রসিং পুনর্বাসনের কাজ শেষ পর্যায়ে। আরও ৮১১টি অবৈধ রেলক্রসিং রয়েছে। আমরা বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় এগুলো পুনর্বাসনে কাজ করছি। নতুন কোনো প্রকল্প নেওয়া হলে তাতেই রেলক্রসিং পুনর্বাসনের কাজ অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।

রেলপথ সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, রেলকে নিরাপদ বাহন নিশ্চিত করতে হলে দুর্ঘটনা রোধ করতেই হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন ও বগি নিয়ে আমরা বেশি চিন্তিত। নতুন ইঞ্জিন ও কোচ বর্তমান সরকার ক্রয় করছে। বর্তমান সরকার রেলের উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। রেল দুর্ঘটনা কমাতে আন্তরিকভাবে কাজ করা হচ্ছে।