ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ৮ই মে ২০২৫, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩২


ছোট্ট এক বাসচালক থেকে বনে যান পরিবহন মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি’র সভাপতি

বাসচালক থেকে বিএনপি - বিএনপি থেকে জাপায় রাঙ্গা


১৪ নভেম্বর ২০১৯ ১৩:২১

আপডেট:
৮ মে ২০২৫ ২৩:১৬

নাম তার রাঙ্গা। রংপুর টু ঢাকা- সর্বত্র এখন চলছে ‘রাঙ্গা ভর্ৎসনা’। নিজ দল জাতীয় পার্টিতেই (জাপা) মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা যেন ‘পার্টির ইমেজের কাঁটা’। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যের পর বেরিয়ে আসছে রাঙ্গার বিতর্কিত রাজনৈতিক উত্থানের কথা।

জাতীয় পার্টির সমালোচিত এই মহাসচিবের শুরুটা নব্বইয়ের দশকে। ছিলেন রংপুরের মোটর শ্রমিক নেতা। আঞ্চলিক রুটের ছোট্ট এক বাসচালক থেকে বনে যান পরিবহন মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতি’র সভাপতি। রাজনৈতিক নাটাইয়ের শুরু জাকের পার্টি দিয়ে। ছিলেন রংপুরের যুবদল নেতা। পরে হঠাৎই ‘এরশাদ বন্দনায়’ জায়গা করে নেন জাতীয় পার্টিতে। ২০০১ সালে এমপি থাকাকালে সক্রিয় ছিলেন বিএনপির ‘হাওয়া ভবনে’। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন ডাইসাইটে নেতা। কব্জায় নেন পার্টির মহাসচিবের পদও। বিতর্কিত এই নেতাকে নিয়ে সমালোচনার ঝড় এখন রাজনীতির মাঠ ছাপিয়ে জাতীয় সংসদে। বহিষ্কারের দাবি উঠছে খোদ জাতীয় পার্টিতেই।

সাবেক প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা এর আগে একাধিকবার সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন। এই কিস্তিতে সমালোচনার সূত্রপাত গত রোববার। জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে ‘গণতন্ত্র দিবস’ উপলক্ষে দেওয়া বক্তব্যে। ওই সময় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্রে পেরেক মেরেছেন, এরশাদ গণতন্ত্রের ধারক-বাহক ছিলেন। গুলিতে ১৮ কৃষক নিহত হয়েছেন, তা হলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া স্বৈরাচার। আর খালেদা জিয়া স্বৈরাচার হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও স্বৈরাচার। গণতন্ত্র পাউডার, তেল বা ফেসওয়াশ নয়। দেশে এক মহিলা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোপাচ্ছেন।’

শহীদ নূর হোসেনকে মাদকাসক্ত আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘তাকে নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি নাচানাচি করে। নূর হোসেন ছিল ইয়াবা ও ফেনসিডিলখোর’। রাঙ্গার এই বক্তব্যের পরপরই ফুঁসে ওঠে গোটা দেশ। সমালোচনার পারদ ছুঁয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে রাঙ্গার নির্বাচনি এলাকা রংপুরে। যদিও বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য তিনি বুধবার সংসদে দাঁড়িয়ে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন।
এর আগেও এক সংবাদ সম্মেলনে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে দেশনেত্রী বলে আখ্যায়িত করে সংশোধনী আনেন জাপা মহাসচিব। যদিও দেশনেত্রী হিসেবে খ্যাত খালেদা জিয়া।
রংপুরের স্থানীয় একাধিক রাজনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাতীয় পার্টিতে হঠাৎ উত্থান মসিউর রহমান রাঙ্গার। পার্টির মনোনয়ন পেয়ে হয়ে ওঠেন বড় ও দাপুটে নেতা। এর আগে ১৯৯৬-৯৭ সালে বিএনপির রংপুরের যুবদল নেতা ছিলেন। ১৯৯৮-৯৯ সালের দিকে জাতীয় পার্টিতে ঢুকে হয়ে যান রংপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক। জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী এই নেতার প্রভাব হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে কেন্দ্র করে। নিজেকে এরশাদের তথাকথিত ‘ভাগ্নে’ বলেও চালাতেন তিনি। এরশাদকে তোষামোদী ও ছলচাতুরী করে নিয়ে নেন ভোটের মনোনয়ন।
এরশাদের এক সময়ের ব্যক্তিগত সহকারী ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মেজর (অব.) খালেদ আক্তার সময়ের আলোকে বলেন, মূলত বিএনপি থেকে জাতীয় পার্টিতে এসেছেন রাঙ্গা। পার্টির প্রয়াত চেয়ারম্যান এরশাদের হাত ধরেই এক প্রকার পার্টিতে প্রবেশ করেন। হয়ে যান রংপুর জেলার সেক্রেটারি। এরশাদের ভাগ্নিকে বিয়ে করেন রাঙ্গার ছোটভাই মোস্তাফিজ। আর তখন থেকেই এরশাদকে ‘মামা’ বলে সম্বোধন করতেন রাঙ্গা। এভাবে গড়ে তোলেন সখ্য।
২০০১ সালে রাঙ্গার সঙ্গে বিএনপির ‘হাওয়া ভবনে’র সখ্য ছিল দাবি করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় পার্টির সাবেক এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, বিএনপি থেকে জাতীয় পার্টিতে ঢুকে ২০০১ সালে প্রথম সংসদ সদস্য হন রাঙ্গা। তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। পরিবহন নেতার বদৌলতে রাঙ্গা নিয়মিত যেতেন তখনকার ‘হাওয়া ভবনে’। সঙ্গে যেতেন এইচএম গোলাম রেজাসহ জাপার কয়েকজন নেতা। গোলাম রেজা গেল জাতীয় নির্বাচনের আগে যোগ দিয়েছেন বি. চৌধুরীর বিকল্পধারায়। তখন থেকেই বিএনপি ও দলের তখনকার সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। ব্যবসায়িক লেনদেনও করতেন। বিএনপির সময়ও লিয়াঁজো করে চালিয়েছেন মারদাঙ্গা পরিবহন ব্যবসা। আর এ ব্যবসায় ‘চাঁদাবাজি’ করে হয়েছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মালিক।
রংপুরের একটি সূত্র জানায়, নব্বইয়ের দশকে প্রথমে মসিউর রহমান রাঙ্গা মোটর শ্রমিক নেতা ছিলেন। রংপুর টু বদরগঞ্জ রুটে চলত তার মালিকানাধীন ছোট্ট একটি বাস। এছাড়া তখন তার নিজস্ব ব্যবসা বলতে কিছুই ছিল না। রাঙ্গার জন্ম লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধা উপজেলার ভেলাগুড়ি ইউনিয়নের কাছিমবাজার এলাকায়। কিন্তু সেখানে শুধু তার বাড়ি ছাড়া কিছু নেই। রংপুরেই তার আধিপত্য।
অন্যদিকে এরশাদের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ জাতীয় বীর নূর হোসেনকে ‘নেশাখোর’ বলায় সংসদ সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গার কড়া সমালোচনা করেছেন গণফোরামের সভাপতি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন। তিনি বলেন, স্বৈরাচারী এরশাদের অনুসারী রাঙ্গার কাছে শহীদ নূর হোসেনের বিষয়ে এ ধরনের বক্তব্য বিচিত্র কোনো ব্যাপার নয়। জনগণই ঐক্যবদ্ধভাবে ভবিষ্যতে এ ধরনের স্বৈরাচারী আচরণ ও কর্মকাণ্ডের জবাব দেবে।