সিন্ডিকেটের নজর এবার চালে

গত দুই মাস ধরে পেঁয়াজের ঝাঁজে নাকাল দেশের মানুষ। এবার কষ্ট বাড়ছে প্রধান খাদ্য চাল নিয়ে। পেঁয়াজ সিন্ডিকেটের পর এবার শুরু হয়েছে চাল নিয়ে চালবাজি। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারে বস্তাপ্রতি চালের দাম বেড়েছে ১৮০-২০০ টাকা। আর কেজিতে বেড়েছে ৫-৮ টাকা পর্যন্ত। তা ছাড়া নওগাঁ, কুষ্টিয়া এবং দিনাজপুরের মিল ও মোকাম পর্যায়ে বস্তাপ্রতি চালের দাম বেড়েছে ১৫০-২০০ টাকা পর্যন্ত।
চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সারা দেশের মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পেঁয়াজের দাম বাড়ার পর মানুষের কষ্ট বেড়েছে, কিন্তু পেঁয়াজের ব্যবহার কমিয়েও দিন পার হয়েছে। কিন্তু চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় কষ্টের সীমা থাকবে না। সে জন্য এ ব্যাপারে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। পেঁয়াজের মতো চালেও যেন সিন্ডিকেট গড়ে উঠতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে। এ বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সময়ের আলোকে বলেন, কোনোভাবেই পেঁয়াজের মতো চালে সিন্ডিকেট গড়তে দেওয়া ঠিক হবে না। সরকারকে দ্রুত এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে, তা না হলে ম্যাসাকার হয়ে যাবে।’
বিভিন্ন এলাকার মিল, পাইকারি ও খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মিনিকেট চালের দাম। মিল মালিক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা দর বৃদ্ধির বিষয়ে প্রায় একই সুরে কথা বলছেন। হঠাৎ করে দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে ব্যবসায়ীরা মৌসুম শেষ হওয়ায় দাম বাড়ছে বলে যুক্তি দিচ্ছেন। তারা বলছেন, ধানের সরবরাহ কমে আসায় চালের দাম বেড়েছে। তবে খুচরা ব্যবসায়ীরা মনে করেন, মিলের কারসাজির কারণেই এবার দাম বাড়ছে। কেননা গত বোরো মৌসুমের ধানের মজুদ এখনই শেষ হওয়ার কথা নয়। এ ধান থেকেই সবচেয়ে বেশি বিক্রীত মিনিকেট চাল উৎপাদন করা হয়। কিন্তু আমন মৌসুমের আগেই ধানের ঘাটতি দেখিয়ে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন মিল মালিকরা।
মিল মালিকরা জানান, বর্তমানে তারা প্রতি মণ ধান কিনছেন ৯৩০-৯৪০ টাকায়। এক সপ্তাহ আগেও এই ধান ছিল ৭৫০ টাকা। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কমে আসায় ধানের দাম বাড়ছে। এতে মিলে চালের দাম বাড়তি। মিল গেটে আগে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ভালো মানের মিনিকেট ১ হাজার ৮৫০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকা ছিল। এখন তা বেড়ে ২ হাজার ১৫০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা হয়েছে। বস্তায় ১০০-১৫০ টাকা বেড়েছে বিআর আটাশ চালের দামও। অন্য চালের দামও বস্তায় গড়ে ১০০ টাকা বাড়তি রয়েছে।
রাজধানীর পুরান ঢাকার বাবুবাজারের বাদামতলী ও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে পাইকারিতে চালের দাম কেজিতে ৪-৫ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। বাদামতলী চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন বলেন, মৌসুমের শেষ সময়ে ধানের দাম বৃদ্ধিতে মিলগুলো দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। এ কারণে পাইকারি বাজারে দাম বাড়ছে। আগে পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট চালের দাম ছিল ৩৮-৪০ টাকা, যা শনিবার বিক্রি হয়েছে ৪২-৪৫ টাকা। ২৮-২৯ টাকা কেজি বিআর-২৮ ও লতা চাল এখন ৩০-৩১ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া ৫০-৫২ টাকা কেজি নাজিরশাইল চালের দাম বেড়ে ৫৪-৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে বর্তমানে মিনিকেট ও বিআর আটাশ চালের চাহিদা রয়েছে। এই দুই পদের চালের দাম বেশি বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। শনিবার খুচরা বাজারে মানভেদে প্রতি কেজি মিনিকেট ৫০-৫২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যা গত সপ্তাহে ছিল ৪৫-৪৮ টাকা। এ ছাড়া বিআর-২৮, লতাসহ অন্য মাঝারি মানের চাল ৩৮-৪২ টাকা ছিল, যা এখন খুচরায় ৪৫-৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর নাজিরশাইল চাল কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ৫৫ টাকার বদলে ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
নওগাঁয় চালের দাম বেড়েছে প্রতি কেজিতে ৪-৫ টাকা
নওগাঁ প্রতিনিধি লোকমান আলী জানান, নওগাঁয় গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে চিকন চালের দাম প্রতি কেজিতে ৪-৫ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর (৫০ কেজি) বস্তা প্রতি বেড়েছে প্রায় ১০০-২০০ টাকা। বাজারে জিরাশাইল ও আটাস জাতের ধানের আমদানি কমে যাওয়ায় চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত থেকে ‘সম্পা কাটারি’ চালের আমদানি বন্ধ হওয়ায় জিরাশাইলের ওপর চাপ পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মিলাররা।
চালকল মালিকরা বলছেন, ধানের দামের সঙ্গে চালের বাজার সামঞ্জস্য না থাকায় লোকসান গুনতে হতো। বেশি দামে ধান কিনে কম দামে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে। যে হারে ধানের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে সে তুলনায় চালের দাম কম। চিকন চালের দাম ৫০ টাকার মধ্যে থাকলে কৃষকরা ধানের দাম পাবেন বলে মনে করছেন তারা। এদিকে হঠাৎ করে চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপাকে পড়েছে সাধারণ ও খেটে খাওয়া মানুষরা।
খুচরা চাল ব্যবসায়ী মহাদেব ঘোষ বলেন, গত এক সপ্তাহ আগে জিরাশাইল বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৩৬ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা। আটাশ বিক্রি হচ্ছে ২-৩ টাকা বেশি দরে বর্তমানে ৩৪-৩৫ টাকায়। এ ছাড়া স্বর্ণা ৩০ টাকা, কাটারি ৫০-৫২ টাকা, পাইজাম ৫০-৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রকার ভেদে মোটা চাল কেজিতে ২ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
মেসার্স সমতা রাইস এজেন্সির প্রোপ্রাইটর সুকুমার বলেন, প্রকার ভেদে প্রতি বস্তায় চালের দাম ১০০-২০০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরদিকে ধানের দাম বেড়েছে প্রতি মণ ১৫০-২৫০ টাকা। এতে করে ধান কিনে চাল উৎপাদন করতে আমাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। শুধু জিরাশাইল চাল ও ধানের দাম বেড়েছে। কিন্তু বাকি সব অপরিবর্তিত রয়েছে।
নওগাঁ ধান ও চাল আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতি সভাপতি নিরদ বরণ সাহা চন্দন বলেন, জিরাশাইল, আটাশ ও উনত্রিশ বছরে একবার বোরো মৌসুমে উৎপাদন হয়ে থাকে। আর সারা বছর ব্যবহার করা হয়। বছরের সাত মাস পেরিয়ে গেছে। এদিকে- কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কাছে ধানের পরিমাণ কমে এসেছে। এই ধান দিয়ে আরও পাঁচ মাস চালাতে হবে। যার কারণে বাজার কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী। প্রতিবছরের এই সময়ে এসে চালের দাম কিছুটা বেড়ে যায়।
দিনাজপুরে চালের দাম বাড়ায় বিপাকে সাধারণ মানুষ
দিনাজপুর থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক আব্দুর রাজ্জাক জানান, দিনাজপুরের বাজারে হঠাৎ করেই চালের দাম বেড়ে গেছে কেজি প্রতি ২-৩ টাকা। দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। কোনো কারণ না থাকলেও দিনাজপুরের বাজারে চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে মিলারদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হচ্ছে। বাজারে ৫০ কেজির প্রতি বস্তায় বেড়েছে ১৫০-২০০ টাকা। ২৮ সিদ্ধ চাল ৫০ কেজির বস্তা আগে বিক্রি হতো ১৬৩০ টাকায় এখন বিক্রি হচ্ছে ১৭৪০-১৭৫০ টাকায়, ২৯ সিদ্ধ চাল প্রতিবস্তা ১৪৫০ থেকে বেড়ে ১৬০০ টাকায়, গুটি স্বর্ণা প্রতি বস্তা ১৫০০-১৭৫০ টাকা, মিনিকেট ১৯০০ থেকে বেড়ে ২১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কাটারি চাল বেড়েছে কেজিপ্রতি ৪-৫ টাকা। এ অবস্থায় সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলো বিপাকে পড়েছেন।
পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, মিলাররা কারসাজি করে দাম বাড়িয়েছে। মিলারদের কাছে পর্যাপ্ত চাল মজুদ থাকার পরও সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়ানোর অভিযোগ করছেন পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা। জেলা চাল কল মালিক গ্রুপের সভাপতি মোছাদ্দেক হুসেন চালের মূল্যবৃদ্ধিতে যেভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে তা সঠিক নয় দাবি করে সময়ের আলোকে বলেন, বাজারে ধানের দাম বাড়ায় চালের দামও কিছুটা বেড়েছে। এখানে সিন্ডিকেটের কিছু নেই বলে তিনি জানান।