ঢাকা বৃহঃস্পতিবার, ৮ই মে ২০২৫, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩২


সিট বাণিজ্যে বেপরোয়া ইডেন ছাত্রলীগ


১৭ নভেম্বর ২০১৯ ১৪:৫৫

আপডেট:
৮ মে ২০২৫ ২২:১৮

রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজের আবাসিক হলগুলোতে বছরের পর বছর ধরে চলছে অবৈধ সিট বাণিজ্য। কলেজের আবাসিক হলের সিট ভাড়ার তুলনায় আশপাশের এলাকার মেসগুলোর কয়েকগুণ বেশি সিট ভাড়া এবং সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাবে বেশিরভাগ ছাত্রীরই লক্ষ্য থাকে কলেজের হলে অবস্থানের। বাইরে থাকতে যেখানে প্রতি মাসে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা সিট ভাড়া গুনতে হয়, সেখানে ইডেনের হলের কক্ষের সিট ভাড়া মাসে ৩৭৫ টাকা। তবে ছাত্রীদের তুলনায় সিট অনেক কম থাকায় বেশিরভাগ ছাত্রীরই সৌভাগ্য হয় না হলে থাকার। আর এই প্রেক্ষাপটকে কাজে লাগিয়ে বছরের পর বছর ধরে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেত্রীরা কলেজটিতে সিট বাণিজ্য করে আসছেন এমন অভিযোগ সাধারণ ছাত্রীদের।

ইডেনে হলের একটি সিট যেন সোনার ডিম পাড়া হাঁস। ফলে সিটের লোভে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেত্রীরা। সিট বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে হলে আধিপত্য ধরে রাখতে এই ছাত্রসংগঠনটির নেত্রীদের মধ্যে প্রায়ই ঘটছে সংঘর্ষের ঘটনাও। সর্বশেষ গত ৯ নভেম্বর কলেজের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে অর্থের বিনিময়ে বহিরাগত ছাত্রীকে সিট দেওয়াকে কেন্দ্র করে শাখা ছাত্রলীগের দুই নেত্রীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। সেদিন নিজ সংগঠনেরই এক নেত্রীর ধারালো অস্ত্রের কোপে আহত হন সাবিকুন্নাহার ওরফে তামান্না নামে এক ছাত্রলীগকর্মী।

অভিযোগ রয়েছে, বছরের পর বছর ধরে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেত্রীরা প্রকাশ্যে সিট বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। কলেজের প্রতিটি হলেই রয়েছে ‘পলিটিক্যাল রুম’। একসময় ‘পলিটিক্যাল রুম’র চেয়ে সাধারণ কক্ষ বেশি থাকলেও বর্তমান চিত্র ভিন্ন। এখন প্রতিটি হলের প্রায় অর্ধেক কক্ষই রাজনৈতিক। এই ‘পলিটিক্যাল রুমে’ সিটে ওঠানোর জন্য প্রথম বর্ষের ছাত্রীদের টার্গেট করছেন ছাত্রলীগ নেত্রীরা। হল কর্র্তৃপক্ষ প্রথম বর্ষের ছাত্রীদের সিট বরাদ্দ না দেওয়ায় ‘পলিটিক্যাল সিটে’ ওঠানোর ক্ষেত্রে প্রথম বর্ষের ছাত্রীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকাও নিচ্ছেন তারা। নবীন ওই ছাত্রীদের কাছ থেকে এককালীন ১৪ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিচ্ছেন ছাত্রলীগ নেত্রীরা। আবার মাস্টার্স শেষ হয়েছে এমন অনেককেও অবৈধভাবে হলে সিট দিচ্ছেন তারা। এ ক্ষেত্রে প্রতি মাসে নেওয়া হচ্ছে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। আর এর সবই হচ্ছে হল প্রশাসনের চোখের সামনেই। তারাও অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছে ছাত্রলীগের কাছে।

বিভিন্ন হলের ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কলেজের আশপাশের এলাকার মেসগুলোতে সিট ভাড়া প্রতি মাসে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। এতে প্রতি বছর শুধু সিট ভাড়াবাবদই কম করে গুনতে হয় ৩৬ হাজার টাকা। সেখানে কলেজের হলে প্রতি বছর সিট ভাড়া দিতে হয় মাত্র সাড়ে ৪ হাজার টাকা।

কলেজ কর্র্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ইডেনে মোট আবাসিক হলের সংখ্যা ছয়টি। এগুলো হলো হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ছাত্রীনিবাস, খোদেজা খাতুন ছাত্রীনিবাস, রাজিয়া ছাত্রীনিবাস, হাসনা বেগম ছাত্রীনিবাস, জেবুন্নেছা ছাত্রীনিবাস এবং শহীদ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রীনিবাস। এই আবাসিক ছাত্রীনিবাসগুলোতে মোট আসনসংখ্যা ৩ হাজার ৩১০। যার বিপরীতে বর্তমানে থাকছেন প্রায় আট হাজার শিক্ষার্থী।

আয়েশা সিদ্দিকা হলের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক আবাসিক ছাত্রী নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমাদের হলে প্রায় এক হাজার সিটের বিপরীতে তিন থেকে চার হাজার ছাত্রী রয়েছে। প্রতি ফ্লোরেই ছয়-সাতটি রুমের মধ্যে তিন-চারটি রুম পলিটিক্যাল। এসব রুমে চারটি করে বেড থাকলেও ১৭ থেকে ১৮ জনও থাকছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যখন হলে উঠেছি তখন বৈধভাবেই বেশি উঠত। কিন্তু এখন পলিটিক্যাল রুম বেশি। ম্যাডামরা প্রথম বর্ষের ছাত্রীদের কম সিট দেন। ফলে এসব ছাত্রী নেত্রীদের ধরে অবৈধভাবে সিট নিচ্ছে। এজন্য নেত্রীদের এককালীন ১৪ থেকে ২০ হাজার টাকা দিচ্ছে তারা। পরবর্তী সময়ে বৈধ হওয়ার পর হল কর্র্তৃপক্ষকে আবার প্রতি দুই বছরের জন্য ৯ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে।’

কলেজের বেশকিছু ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে ছাত্রীনিবাসগুলোতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সিট বাণিজ্যের অভিযোগ করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এদের মধ্যে রয়েছে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক তাসলিমা আক্তার, যুগ্ম আহ্বায়ক শাহানাজ আক্তার, নাসিমা আক্তার, মাহবুবা নাসরিন রূপা, আঞ্জুমান আরা অণু, জান্নাত আরা জান্নাত, রিভা আক্তার, পাপিয়া আক্তার প্রিয়া, বিপাশা হায়াত রনি, বিথি আক্তার ও ইতি আক্তার।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুবা নাসরিন  বলেন, ‘অণুর যন্ত্রণায় আমরা অতিষ্ঠ। একাধিকবার তাকে নিয়ে বৈঠক করেছি শোধরানোর জন্য। কিন্তু সে কারও তোয়াক্কা করে না।’

ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সহসম্পাদক এবং ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আঞ্জুমান আরা অণুর সমর্থকদের বিরুদ্ধেও রয়েছে সিট বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পদ পাওয়াতে তার সমর্থকরা হলে বেপরোয়া আচরণ করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে অণু দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য নয়। সিট বাণিজ্যের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তাছাড়া ইডেনে এখন কোনো কমিটিও নেই।’ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের সংঘর্ষের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি ক্যাম্পাসে ছিলাম না। ইডেনের হলে পলিটিক্যাল বলে কোনো রুম নেই। সব রুমেই কলেজের ছাত্রীরা থাকেন। ম্যাডামরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে রুম বরাদ্দ দিয়ে থাকেন। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে ভাইভা নিয়ে রুমে ওঠানো হয়।’

অন্যদিকে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক তাসলিমা আক্তার দেশের বাইরে অবস্থান করায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

হলে সিট বাণিজ্যের বিষয়ে জানতে ইডেন মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ শামসুন নাহারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।