ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গ্যাস সরবরাহ,
মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপলাইনেই গ্যাস সরবরাহ, যোকোন মুহুর্তে ভয়াবহ দুর্ঘটনা

মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপলাইনেই চলছে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গ্যাস সরবরাহ। ঢাকায় ৪০-৪৫ বছরের বেশি সময়ের পুরনো গ্যাস বিতরণ লাইনও রয়েছে। সংযোগ লাইনে হচ্ছে লিকেজ, ঘটছে দুর্ঘটনা। সর্বশেষ রোববার চট্টগ্রাম নগরীর পাথরঘাটা এলাকায় গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণে সাতজন নিহত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাইপলাইনের লিকেজ থেকে ফের নিমতলী-চুড়িহাট্টার মতো বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে মানসম্পন্ন কোম্পানি দিয়েই এসব পাইপলাইন স্থানান্তর করতে হবে। তিতাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি বলছে, এসব পাইপলাইন বদলাতে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। নেওয়া হয়েছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প।
গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মতো এখন গ্যাস পাইপলাইনের লিকেজের কারণেও দুর্ঘটনা বাড়ছে। এর আগে গত মার্চ মাসে রাজধানীর কাঁঠালবাগান ফ্রি স্কুুল স্ট্রিটে পাইপলাইনের লিকেজের কারণে অগ্নিকান্ড ঘটে। দীর্ঘদিন ধরেই ওই এলাকার বিভিন্ন গ্যাস লাইনে লিকেজের অভিযোগ করে আসছিলেন এলাকাবাসী।
তাদের অভিযোগ, রাস্তায় হাঁটলে প্রায় সময়ই গ্যাসের গন্ধ নাকে আসত। তবে তাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এর আগে গত ২২ ফেব্রুয়ারি জুরাইনের আইজি গেট এলাকায় গ্যাস পাইপলাইনের লিকেজ থেকে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। তার দুদিন আগে রাজধানীর ধানমন্ডির শুক্রাবাদে গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন লাগলে যাত্রীসহ আটজন দগ্ধ হন।
এর আগেও চলতি বছর এ ধরনের বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত দুই বছরে দেশে গ্যাস দুর্ঘটনায় দুই শতাধিক অগ্নিকান্ড ঘটেছে। এর মধ্যে গ্যাসলাইন লিকেজে দুর্ঘটনা হয়েছে ৯০টিরও বেশি। বাকি দুর্ঘটনাগুলো ঘটে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকায় ৪০-৪৫ বছরের বেশি সময়ের পুরনো গ্যাস বিতরণ লাইন রয়েছে। এসব গ্যাসলাইনের তেমন তদারকি নেই তিতাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির। গ্যাসলাইনে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না করা এবং বাড়ির মালিক ও ভাড়াটেদের অসাবধানতা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এ ছাড়া বাসাবাড়িতে সঠিকভাবে গ্যাসলাইন সংযোগ, এলপিজি সিলিন্ডার এবং চুলার ফিটিংস সঠিকভাবে না হওয়ার কারণেও অগ্নিকান্ড ঘটছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস পাইপ কিংবা সিলিন্ডার লিকেজ থেকে গ্যাস বের হলে শব্দ এবং পচা ডিমের মতো দুর্গন্ধ ছড়াবে। এ ধরনের গন্ধ পাওয়ামাত্র জানালা দরজা খুলে গ্যাস বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষ একটু সচেতন হলে আগুন থেকে অনেকটাই পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার। কিন্তু তা করা হয় না। সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো দরকার।
তিতাস গ্যাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ১৯৬৭ সালে প্রথমবারের মতো ঢাকা শহরে গ্যাস সরবরাহের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৭-৬৮ সালে ডেমরা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত ১২ ইঞ্চি এবং ডেমরা থেকে পোস্তগোলা ১৪ ইঞ্চি ও ১০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়। চাপ প্রশমন করে ২ ইঞ্চি থেকে ৬ ইঞ্চি ব্যাসের বিতরণ নেটওয়ার্ক স্থাপন করে গ্রাহকদের গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়। এরপর থেকে নব্বই দশকের প্রথম ভাগ পর্যন্ত ঢাকা শহরের বিভিন্ন অংশে ৫০ পিএসআই (প্রতি বর্গফুটে গ্যাসের চাপ) চাপের বিভিন্ন ব্যাসের বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হয়। সেই নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহর এলাকা ক্রমান্বয়ে বর্ধিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্কও সম্প্রসারণ করা হয়। ৫০ পিএসআই চাপের বিভিন্ন ব্যাসের বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হয়। এই পাইপলাইনগুলোর মেয়াদকাল ছিল ৩০ বছর। কিন্তু এখনও সেই পাইপলাইন ব্যবহার হচ্ছে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, রান্না করার সময় অবশ্যই দরজা জানালা খুলে রাখতে হবে, যাতে গ্যাসের লাইন লিক হয়ে রান্নাঘরে গ্যাস জমে না থাকে। দুর্ঘটনারোধে গ্রাহক পর্যায়ে রাত ১২টার পর থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, দুর্ঘটনা এড়াতে রুটিনমাফিক গ্রাহকদের কিচেন পরিদর্শনের ব্যবস্থা এবং গ্যাস সরবরাহ ও তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও সতর্ক ভূমিকা রাখতে হবে। পুরনো পাইপলাইনগুলো নতুন করে করা না হলে নিমতলী বা চুড়িহাট্টার মতো দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থেকেই যাবে। তিতাসের মোট ১২ হাজার ২৫৩ কিলোমিটার পাইপলাইন রয়েছে। গ্রাহক সংখ্যা ২০ লাখেরও বেশি।
বর্তমানে ঢাকা শহর বিতরণ নেটওয়ার্কে প্রায় ৭ হাজার কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপিত আছে। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের লাইনের মধ্যে প্রায় ৫ হাজার কিলোমিটার অনেক আগেই পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অল্প অল্প মেরামতের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ সচল রাখা হচ্ছে বলে জানান তিতাসের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া বিভিন্ন সংস্থার উন্নয়নমূলক কাজে রাস্তা মেরামত, ড্রেন নির্মাণ ও বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে গ্যাস পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অন্যদিকে ক্যাথডিক প্রটেকশন (সিপি) ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে লিকেজের সৃষ্টি হচ্ছে। কম ব্যাসের পাইপগুলোর পুরুত্ব কম থাকায় লিকেজের পরিমাণ বাড়ছে। এ ছাড়া পাইপলাইনে পানি ঢোকায় গ্রাহক অংশে গ্যাস সংযোগে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় গত মার্চ মাসে তিতাস বেশকিছু পরিকল্পনা হাতে নেয়। এ জন্য ঢাকা শহরকে ১৪৩টি এলাকায় বিভক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে স্বল্পচাপ সমস্যা, ক্ষতিগ্রস্ত পাইপলাইন ও স্বল্প ব্যাসের পাইপ লাইন বিবেচনায় প্রথম পর্যায়ে ৬০টি এলাকায় নেটওয়ার্ক উন্নীতকরণের বিষয়টি বিবেচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে বাকি ৭৯টি এলাকায় নেটওয়ার্ক উন্নীতকরণ করা হবে।
পরিকল্পনার বিষয়ে তিতাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ডিপিপি প্রণয়নের আগে পুরো ঢাকার কোথায় কোথায় পাইপলাইন বসানো হবে তার জরিপ করা হচ্ছে। যেখানে রাস্তার নিচে পাইপলাইন আছে সেসব রাস্তার মাপ নেওয়া হয়েছে। তিতাসের নিজস্ব অর্থায়নেই এই কাজ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী ১৪৩টি ব্লকে কাজ করা হবে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে ৬০টি ব্লকে কাজ হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে বাকি কাজ করা হবে ধারাবাহিকভাবে।
আগামী তিন বছরের মধ্যে পুরনো পাইপলাইন বদলে ফেলার লক্ষ্যেই বিশেষ করে ২০-৩০ বছরের পুরনো পাইপলাইনগুলো বদলে ফেলতেই কাজ করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে এবার পুরনো পাইপলাইন সরিয়ে নতুন করে পাইপ স্থাপনে বড় প্রকল্প গ্রহণ করেছে সরকার। ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নিশ্চিত হবে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ। আগামী তিন বছরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। এরপরই নতুন সংযোগের বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।