ঢাকা শুক্রবার, ৯ই মে ২০২৫, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩২


সেই আবজালের ক্রোক করা ৪ বাড়ির ভাড়া তুলছেন স্বজনরা!


২১ নভেম্বর ২০১৯ ১৫:৪০

আপডেট:
৯ মে ২০২৫ ০৩:২৭

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরখাস্ত হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেন ও তার স্ত্রী রুবিনা খানমের ক্রোক করা ঢাকা ও ফরিদপুরের চারটি বাড়ি থেকে ভাড়া তুলছেন স্বজনরা। এছাড়া ফরিদপুরে একটি ইটভাটা ও আটটি ছোট কার্গো জাহাজও রয়েছে তার পরিবারের তত্ত্বাবধানে। অথচ নিয়মানুযায়ী ক্রোক করা এসব সম্পদ তদারকি করার কথা সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার।

আলোচিত আবজাল-রুবিনা দম্পতি পলাতক থাকায় দেশে থাকা তাদের সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ আট মাস আগে আদালতের নির্দেশে জব্দ হয়। নিষেধাজ্ঞা ফাঁকি দিয়ে এ দম্পতি অস্ট্রেলিয়া চলে গিয়ে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন তাদের উত্তরার বাড়ির কেয়ারটেকার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হয়েও গেল ২০ বছরে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন আবজাল। চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। বিদেশ গমনে দেওয়া হয় নিষেধাজ্ঞা। এরপরই গা ঢাকা দিয়ে সস্ত্রীক দেশ ছাড়েন আবজাল। ফরিদপুরে আবজালের জব্দ হওয়া বাড়ি ও বেশকিছু সম্পদ তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছেন বোনজামাই মো. হালিম শেখ এবং

স্থানীয়দের কাছে আবজালের ঘনিষ্ঠতম ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ফরিদপুর আয়কর বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী খোকন।

সরেজমিন ফরিদপুর শহরের টেপাখোলা লেকপাড় এলাকায় গিয়ে আবজালের মালিকানাধীন দ্বিতল ডুপ্লেক্স বাড়িটি দেখতে পাওয়া যায়। ফরিদপুরের মতো মফস্বলে এমন সুরম্য প্রাসাদে প্রথম দেখায় চোখ আটকে যাবে যে কারোই। বাড়িটিতে আছে অত্যাধুনিক সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। বাড়ির চারপাশে বসানো হয়েছে ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আবজালের এই বাড়িটি দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে জব্দ করা হয়েছে। তবে বাড়িটিতে দুদকের পক্ষে লাগানো ক্রোকাদেশের কোনো সাইনবোর্ড এই প্রতিবেদকের চোখে পড়েনি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুদকের সেই নোটিস অনেক আগেই ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। বাড়িটি এখনো আবজালের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। সেখানে বর্তমানে বসবাস করছেন তার বোনজামাই মো. হালিম শেখ।

জব্দ করা বাড়িতে থাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে হালিম শেখ  বলেন, ‘তারা (আবজাল-রুবিনা) একটু সমস্যায় আছে। এজন্য বাড়িটি দেখাশোনার জন্য আমার পরিবার নিয়ে এখানে আছি।’ তবে আদালত জব্দ করার পরও কীভাবে রয়েছেন তা জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

আবজালের মালিকানাধীন আরেকটি দ্বিতল ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে টেপাখোলা লেকপাড় সংলগ্ন এলাকায়। ওই বাড়িটিও হালিম শেখের তত্ত্বাবধানে রয়েছে বলে দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে। এছাড়া ফরিদপুর থেকে দেশের বিভিন্ন নদীবন্দরে চলাচলকারী আবজালের মালিকানাধীন আটটি ছোট কার্গো জাহাজ তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছেন আয়কর বিভাগের সাবেক কর্মচারী খোকন।

এদিকে রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর রোডের ৪৭ নম্বর হোল্ডিংয়ে তামান্না ভিলা নামে একটি ছয়তলা বাড়ি রয়েছে আবজাল দম্পতির। এই বাড়িটিও আদালতের নির্দেশে জব্দ করেছে দুদক, তবে এখনো ভাড়া যাচ্ছে আবজালের পকেটেই। বাড়িটির কেয়ারটেকার রিপন ইসলাম জানিয়েছেন, চলতি বছর ১০ জানুয়ারি দেশ ছেড়েছে আবজাল দম্পতি।

তামান্না ভিলার ভাড়াটিয়া রেজোয়ান আহম্মেদ জানান, পাঁচ মাস আগে বাড়িটিতে ওঠার পর থেকে তিনি কেয়ারটেকার রিপন ইসলামের কাছে ভাড়ার টাকা জমা দিচ্ছেন। এ সময়কালে বাড়িটির ভাড়া আদায়ের জন্য দুদকের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী তার কাছে আসেননি।

জব্দ করার পরও আবজালের বাড়িসহ বিভিন্ন সম্পদ পরিবারের তত্ত্বাবধানে থাকার ব্যাপারে জানতে চাইলে দুদকের ফরিদপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ গতকাল বুধবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আবজালের মামলাটি দেখাশোনা করে হেড অফিস থেকে। আমাদের কাছে আদালতের নির্দেশনা আসার পর বাড়িতে নোটিস টানিয়ে দিয়েছিলাম। তবে এখন কী অবস্থা সেটা দ্রুত সময়ের মধ্যে দেখে আমাদের প্রধান কার্যালয়ে জানাব।’

গত ২১ জানুয়ারি দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আবজাল ও তার স্ত্রী রুবিনার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক অর্থাৎ হস্তান্তর বা লেনদেন বন্ধ এবং ব্যাংক হিসাবগুলোর লেনদেন জব্দ (ফ্রিজ) করার আদেশ দেয় ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত। এর আগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি আবজাল, তার স্ত্রী রুবিনা এবং তাদের ১৫ নিকটাত্মীয়ের আরও সম্পদের খোঁজে মাঠে নামে সংস্থাটি।

আবজাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেডিকেল এডুকেশন শাখার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ছিলেন। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তার স্ত্রী রুবিনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার সাবেক স্টেনোগ্রাফার। চাকরি ছেড়ে তিনি রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে ব্যবসা করতেন। দুদকের তথ্য অনুযায়ী, আবজাল বেতন পেতেন সব মিলিয়ে মাসে ৩০ হাজার টাকার মতো। অথচ চড়তেন হ্যারিয়ার ব্র্যান্ডের গাড়িতে। ঢাকার উত্তরায় তার ও স্ত্রীর নামে বাড়ি আছে পাঁচটি। আরেকটি বাড়ি আছে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় আছে অন্তত ২৪টি প্লট ও ফ্ল্যাট। দেশ-বিদেশে আছে বাড়ি-মার্কেটসহ অনেক সম্পদ। এসব সম্পদের বাজারমূল্য হাজার কোটি টাকারও বেশি। এ দম্পতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমে গত ১০ জানুয়ারি আবজালকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। রুবিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত ১৭ জানুয়ারি দুদকে হাজির থাকতে বলা হলেও তিনি সময় চেয়ে আবেদন করেন। এর আগে আবজাল ও রুবিনার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয় দুদক।