রোহিঙ্গা নিয়ে চাপে মিয়ানমার

মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিজে) দেশটির বিরুদ্ধে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার করা মামলার শুনানি হবে আগামী ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, ওআইসিভুক্ত দেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে ওই শুনানিতে মিয়ানমারের উদ্দেশ্যমূলকভাবে জাতিগত নিধন এবং খুন, হত্যা, ধর্ষণের তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরা হবে।
কূটনৈতিক বিশেস্নষকরা বলছেন, মিয়ানমারের পক্ষে দেশটির কার্যত নেতা শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চির লড়ার ঘোষণা শুধুই রাজনৈতিক হতে পারে। শেষ পর্যন্ত তিনি হয়তো এ শুনানিতে অংশ নেবেন না– এমনটাই মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল। গত ১৯ নভেম্বর গাম্বিয়া আইসিজেতে মামলা করার পর থেকেই দেশটির বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় ওঠে। বিপরীতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনেক উজ্জ্বল হয়েছে। এ মামলার ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিত্রদের নিয়ে মিয়ানমারের কৌশলের বিষয়টিও উঠে আসবে বলেও মনে করছেন তারা।
কূটনৈতিক বিশেস্নষক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালি উর রহমান বলেন, ‘গাম্বিয়ার এ উদ্যোগকে সর্বাত্মকভাবে সফল করতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সব তথ্য-প্রমাণ সরবরাহ করতে হবে। এখানে রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ যে সংকটে রয়েছে সেটিও তুলে ধরতে হবে। মোট কথা বাংলাদেশের জন্য এটা মোক্ষম সুযোগ।
বিষয়টি রাজনৈতিক না হলেও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতার কারণে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার ড়্গেত্রে মিয়ানমার যে মিথ্যাচার করছে সেটিও এ সুযোগে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে তুলে ধরতে হবে। ইতিমধ্যে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে নির্যাতনের কথা শুনেছেন, চিহ্ন দেখেছেন এবং মিয়ানমারে গিয়েও গণহত্যার আলামত পেয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ওআইসির সদস্য হিসেবে আমরা আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের তথ্য-প্রমাণ দিতে পারব।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বরের শুনানিতে তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরতে বাংলাদেশ প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভিডিও ফুটেজসহ প্রমাণাদি গাম্বিয়াকে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নষ্ট করতে চায় না। আর এ মামলার পক্ষ বাংলাদেশ নয়। ওআইসি থেকেই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যা মামলার সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে গত ওআইসি সম্মেলনেই এ সিদ্ধান্ত হয়। তিনি বলেন, অনেকেই বলতে পারে বাংলাদেশ কেন মামলা করেনি বা গাম্বিয়ার মতো ছোট একটি দেশ কেন মামলা করল। এখানে বিষয়টি স্পষ্ট, গাম্বিয়ার মামলা এ কারণে শক্তিশালী যে, এ মামলায় ভূরাজনৈতিক এবং অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। একটি দেশ থেকে মুসলিম নিধন করা হচ্ছে। গাম্বিয়া তথ্য-প্রমাণাদিসহ সেটি তুলে ধরবে। শক্তিশালী প্রমাণ দিতে পারলে মিয়ানমারের বিচার হবে গণগত্যার দায়ে। সৌদি আরব মামলা করতে চেয়েছিল। এ গণহত্যার বিষয় শুধুই বাংলাদেশের নয়।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পক্ষে। একটি রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কখনই অবস্থান নেয়নি। গণহত্যার বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়েছে। গত ১১ নভেম্বর গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী আবু বকর তামবাদুর আন্তর্জাতিক আদালতে ৪৬ পৃষ্ঠার এক অভিযোগপত্রে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা, ধর্ষণ ও বাড়িঘর জ¦ালিয়ে দেওয়াসহ গুরুতর অভিযোগ আনেন। অভিযোগে বলা হয়, ২০১৭ সালের অক্টোবরে রোহিঙ্গা নিধনে অভিযান চালায় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। রোহিঙ্গা হত্যা, নারী ও শিশু ধর্ষণসহ বিভিন্ন যৌন নিপীড়ন চালায় তারা। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তারা প্রাণভয়ে পালিয়ে যায়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা গতকাল জানান, ওআইসির পক্ষে গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) যে মামলা করেছে তার শুনানি হবে নেদারল্যান্ডসের হেগে আগামী ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এ মামলায় সেখানকার সামরিক জান্তার পক্ষে শুনানিতে অংশ নিতে ওই সময়ে হেগে যাচ্ছেন অং সান সু চি। যদিও অন্যদিকে আর্জেন্টিনায় সরাসরি সু চির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তদন্তও শুরু হচ্ছে।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে যেমন তথ্য রয়েছে তেমনি বাংলাদেশের কাছেও মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের তথ্য রয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণে বেঁচে আসা ১০ লাখ রোহিঙ্গাই এর বড় প্রমাণ। তিনি বলেন, গাম্বিয়ার এ মামলা আমাদের জন্য ইতিবাচক হয়েছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলায় বাংলাদেশেরও কাজ করার সুযোগ আছে। আমাদের পক্ষ থেকে সতর্কভাবে এগোতে হবে। গাম্বিয়ার এ মামলায় সু চি নিজেও চাপে পড়েছে। কারণ এ ঘটনার পর নোবেল ছাড়া তার সবকটি পুরস্কার তুলে নেওয়া হয়েছে।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে মিয়ানমারের রাখাইনে নির্যাতনের শিকার হয়ে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে।