বিদিশা-জিএম কাদেরের রশি টানাটানি
অঢেল সম্পদই এখন সমস্যা এরিকের

এরশাদের মৃত্যুর পর আলোচনা এখন তার পুত্র এরিক ও সাবেক স্ত্রী বিদিশাকে ঘিরে। আগে থেকেই এরশাদের বাসভবন প্রেসিডেন্ট পার্কে থাকা এরিক এবার তার মাকেও নিয়ে এসেছেন সেখানে। ছেলের আবদার মা যেন তার সঙ্গে থাকেন সবসময়। মা বিদিশা সিদ্দিকও থাকতে চান প্রেসিডেন্ট পার্কে। কিন্তু এই থাকাকে সম্পূর্ণ বেআইনি ও অবৈধ অ্যাখ্যা দিয়ে থানায় বিদিশার বিরুদ্ধে জিডিও করা হয়েছে। তবে বিদিশা তার বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ছেলে এরিকের ‘সুখ-শান্তির’ জন্য প্রেসিডেন্ট পার্কে থাকতে চান। এদিকে এরিকের দাবি, চাচা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের তার সম্পত্তির ওপর লোভ করছে। মা বিদিশাও একই সুরে রোজ মিডিয়ার বক্তব্য দিচ্ছেন। ছেলের ‘ভবিষ্যতের’ জন্য বিলাপ করছেন। কিন্তু হঠাৎ কেন এরিককে নিয়ে এত টানাটানি, এত ভালোবাসা?
এরিককে নিয়ে মা বিদিশার কার্যকলাপকে একটু ‘বাড়াবাড়ি’ বলছেন জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা। তাদের দাবি, বিদিশা সম্পদের লোভেই এত দরদ দেখাচ্ছেন। অনেকটা ‘মায়াকান্না’ করছেন। ছেলেকে বুঝিয়ে পড়িয়ে অনেক কথা মিডিয়াতে বলাচ্ছেন। পার্টি থেকে দূরে আছেন এমন একজন সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, এরশাদের ট্রাস্টের এরিক এখন সাবালক। কিন্তু তাকে ‘এবনরমাল’ প্রমাণের চেষ্টা করছেন মা বিদিশা সিদ্দিক। তিনি অনেক কথা এরিককে মুখস্থ করিয়ে বলাচ্ছেন। তবে জিএম কাদেরের কাজকেও ‘অতিরিক্ত দায়িত্ব’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, জিএম কাদের ট্রাস্টের কেউ নন। আর ট্রাস্টেও উনার কোনো অধিকার নেই। উনি প্রেসিডেন্ট পার্কে ঢুকতে বিদিশাকে কেন বাধা দেওয়ার কথা বলেন? উনি পার্টির বাইরের বিষয়ে নাক গলালে ‘লোভের’ কথা উঠবেই।
রওশন এরশাদপন্থি বলে পরিচিত সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, এরিককে নিয়ে বিদিশা ও জিএম কাদেরের ঘটনাগুলো একান্তই পারিবারিক। এটা মা-চাচার দ্বন্দ্ব। এক দিকে মা, আরেকদিকে চাচা-দুয়ে মিলে এটিকে পাবলিক ইস্যু বানিয়ে ফেলছে। আমরা পর্যবেক্ষণ করছি, দেখা যাক কি হয়!
এ বিষয়ে জিএম কাদের কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, প্রয়োজন হলে আমার বক্তব্য পার্টির পক্ষ থেকে প্রেস রিলিজ আকারে দেওয়া হবে। আমি কিছু বলব না। এরশাদের ট্রাস্টের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মেজর (অব.) খালেদ আখতার সময়ের আলোকে বলেন, ট্রাস্টে লোভ করে লাভ নেই। চাইলেও কেউ কোনো সম্পত্তি বিক্রি করতে পারবে না। এমনকি এরিকও পারবে না। এরিকের অবর্তমানে ট্রাস্ট সরকারের অধীনে চলে যাবে। এরিককে শিখিয়ে দেওয়া হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এরিককে আমরা ছোটকাল থেকে চিনি। এগুলো তার নিজস্ব বক্তব্য না। সে খুব বুদ্ধিমান, পরিপক্ব। অপেক্ষা করেন, দুদিন পর এই বিদিশার বিরুদ্ধেই এরিক বক্তব্য দেবে। এরিকের দেখভালের দায়িত্ব ট্রাস্টের। এ প্রসঙ্গে বারবার যোগাযোগ করে সাড়া পাওয়া যায়নি বিদিশা সিদ্দিকের।
এরশাদের বাসভবনে বিদিশার অবৈধভাবে প্রবেশের অভিযোগ তুলে শনিবার গুলশান থানায় এ জিডিটি করেন এই মেজর খালেদ। জিডিতে বলা হয়েছে, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর তার বাসভবন প্রেসিডেন্ট পার্ক যথারীতি ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। ট্রাস্টের ওই বাসায় গত ১৪ নভেম্বর প্রয়াত এরশাদের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিক সম্পূর্ণ অন্যায় ও অবৈধভাবে প্রবেশ করেন। ওই জমিতে বিদিশা সিদ্দিকের প্রবেশ করার আইনগত কোনো অধিকার নেই বলেও উল্লেখ করা হয় জিডিতে।
২০০২ সালে এরশাদ ও বিদিশার বিবাহ বিচ্ছেদের পর ২০০৬ সালে এরিকের অভিভাবকত্বের দাবিতে আদালতে যান বিদিশা। পরে ২০০৯ সালে আসে রায়। সে রায়ে হেরে যান বিদিশা। এরিক বড় হতে থাকেন এরশাদের প্রেসিডেন্ট পার্কে। জানা যায়, এরশাদ মারা যাওয়ার আগে এরিকের নামে এফডিআর, বারিধারার দূতাবাস রোডের প্রেসিডেন্ট পার্ক, গুলশানে একটি আবাসিক ফ্ল্যাট, রংপুরের পল্লী নিবাস, একটি কোল্ডস্টোরেজ, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউতে ইউএই মার্কেটে একটি দোকান রেখে গেছেন। খালেদ আখতার জানান, এই সম্পত্তির অর্থ মূল্য ‘৫ থেকে ৬ কোটি টাকা’। প্রেসিডেন্ট পার্কের ফ্ল্যাটসহ প্রয়াত এরশাদের সব স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি এখন ট্রাস্টের অধীনে। যা এরশাদপুত্র এরিকের ভরণ-পোষণ ও জনকল্যাণে গঠিত হয়েছে বলে ডায়েরিতে উল্লেখ করেন তিনি।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কত টাকার সম্পত্তি রেখে গেছেন সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই কারও কাছেই। কোনো সম্পত্তি তিনি কাকে দিয়ে গেছেন, তা নিয়ে এখনও রয়েছে ধোঁয়াশা। তবে সাবেক এই রাষ্ট্রপতি তার সম্পদের একটি অংশ ট্রাস্টে দান করেছেন এবং বাকিটা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বণ্টন করে দিয়ে গেছেন বলে তার পরিবারের ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় এরশাদ নির্বাচন কমিশনে যে হলফনামা জমা দিয়েছিলেন, তাতে এরশাদ তার বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন ১ কোটি ৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া ব্যবসা থেকে তার আয় দেখান ছয় লাখ ৬ হাজার ৫০০ টাকা। এর বাইরে ২ লাখ টাকা দামের একটি দোকান রয়েছে তার। স্ত্রীর গুলশানের দুটি ফ্ল্যাটের দাম ৮০ লাখ টাকা। এর বাইরে বসুন্ধরায় একটি ফ্ল্যাট এবং ঢাকার পূর্বাচল ও রংপুরে ৫০ লাখ টাকার বেশি দামের দুটি জমি রয়েছে স্ত্রীর নামে।
এরশাদের কোনো কৃষি ও অকৃষি জমি নেই। তবে ৭৭ লাখ টাকা দামের দোকান, বারিধারায় ৬২ লাখ ৪০ হাজার টাকা দামের ফ্ল্যাট এবং গুলশানে ৬২ লাখ টাকা দামের আরেকটি ফ্ল্যাটের কথা হলফনামায় লেখেন তিনি। স্ত্রীর নামে ৩৩ লাখ টাকা দামের রংপুরে এবং ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দামের জমি রয়েছে ঢাকার পূর্বাচলে। পূর্বসূত্রে পাওয়া বসুন্ধরায় ফ্ল্যাট রয়েছে এরশাদের। গুলশানের দুটি ফ্ল্যাটের একটির মূল্য ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা, আরেকটির দাম ৫০ লাখ টাকা। হলফনামায় এরশাদ ঋণ দেখিয়েছেন ইউনিয়ন ব্যাংকে ৫৬ লাখ ১৯ হাজার ৬৮৯ টাকা এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ১ কোটি ৭৫ লাখ ৮৪ হাজার ৯৪৬ টাকা।
এরশাদ তার সম্পত্তির কতটুকু কাকে দান করেছেন, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য জাতীয় পার্টির নেতারাও স্পষ্ট করতে পারেননি। অনেকের দাবি, এরশাদ তার নিজ বাসভবন ‘প্রেসিডেন্ট পার্ক’ সাবেক স্ত্রী বিদিশার ছেলে এরিক এরশাদকে দিয়েছেন। আর তার গুলশানের বাড়িটি দিয়ে গেছেন রওশন এরশাদকে। জন্মস্থান রংপুরের সম্পত্তি আপন ভাই জিএম কাদের ও ভাতিজা আতিক শাহরিয়ারকে দেওয়া হয়েছে।