ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ছুঁই ছুঁই

গ্রীষ্ম থেকে বর্ষা কিংবা শরৎ, তারপর হেমন্ত পেরিয়ে শীত চলে এসেছে। এতদিন ঋতুর সঙ্গে মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের সংশ্লেষের বিষয়টি বিশেষজ্ঞরা বললেও এবার তা মিলছে না। এখনও পুরোপুরি ডেঙ্গুর প্রকোপ কমেনি। প্রতিদিনই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছে নতুন রোগী।
অন্যদিকে এ বছরের মতো বাংলাদেশে ডেঙ্গুর এমন বিস্তার এর আগে কখনও দেখা যায়নি। এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ এ বছর অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ২০০০ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী আরও ১৮ বছরে যেখানে সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার ১৪৮ জন, সেখানে চলতি বছর এ পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ১ লাখ ছুঁই ছুঁই।
আর বেসরকারি হিসাবে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা তিনশ ছাড়িয়েছে।
ডেঙ্গুর ভয়াবহতা তাই নতুন ভাবনায় ফেলেছে দেশবাসীকে। মনে করা হতো এডিস মশা শুধু দিনের বেলাতেই কামড়ায়।
তবে কীটতত্ত¡বিদরা বলছেন অন্য কথা। ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ডেঙ্গুর মূল কারণ এডিস ইজিপ্ট মশা; এই প্রজাতির মশাদের ৮৪ শতাংশই কামড়ায় দিনের আলোয়। ১৬ শতাংশ কামড়ায় রাতের বেলা। রাত মানে একদম অন্ধকার। সময়টা সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা কিংবা ভোর ৪টা থেকে সকাল ৬টায় আলো ফোটার আগ পর্যন্ত। আবার সকাল ৬টার পর এদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। দিনের বেলায় এডিস ইজিপ্ট মশা কামড়ানোর সময় সকাল ৭টা থেকে ১০টা। আবার বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা। এডিস অ্যালবোপিকটাস ১০ শতাংশ ক্ষেত্রেই রাতে কামড়ায়। আবার রাতের বেলা যদি দিনের মতো আলো জ্বলে, তাহলে এডিস ইজিপ্টের আচরণ কিন্তু দিনের মতোই হয়। এই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, এডিস মশা এতটাই ভয়ঙ্কর এরা যেকোনো আবহাওয়ায় বেঁচে থাকতে পারে। পাশাপাশি এই প্রজাতির মশা খুব দ্রæত একটি মশা থেকে আরেকটি মশার মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত ভর্তি ৯৯ হাজার ২৩ জন ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৯৮ হাজার ১৯৫ জন। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার ৪১টি হাসপাতাল থেকে ৫০ হাজার ১৫৮ ও বিভাগীয় হাসপাতাল থেকে ৪৮ হাজার ৩৭ জন বাড়ি ফিরে গেছেন।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ৫০ হাজার ৬২১ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভাগীয় হাসপাতালে ৪৮ হাজার ৪০২ জনসহ সর্বমোট ৯৯ হাজার ২৩ জন ভর্তি হন। জানুয়ারিতে ৩৮, ফেব্রæয়ারিতে ১৮, মার্চে ১৭, এপ্রিলে ৫৮, মে মাসে ১৯৮, জুনে ১ হাজার ৮৮৪, জুলাইয়ে ১৬ হাজার ২৫৩, আগস্টে ৫২ হাজার ৬৩৬, সেপ্টেম্বরে ১৬ হাজার ৮৫৬, অক্টোবরে ৮ হাজার ১৪৩ ও ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৯২৭ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন।
চলতি বছর ডেঙ্গুতে ২৫১ জনের মৃত্যুর তথ্য রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইডিসিআর) পাঠানো হয়। এর মধ্যে ১৭৯ জনের মৃত্যু পর্যালোচনা করে ১১২ জনের মৃত্যু ডেঙ্গুর কারণে হয়েছে বলে নিশ্চিত করে সংস্থাটি। তবে বেসরকারি হিসাবে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা তিনশ ছাড়িয়েছে।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ডেঙ্গু এডিস মশাবাহিত একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এখন পর্যন্ত এর সুপরিচিত কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও অন্যান্য মহাদেশের ১১০টির অধিক দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হয়। বিশে^র জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশের ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর ঝুঁকি রয়েছে। প্রতিবছর বিশে^র বিভিন্ন দেশে প্রায় পাঁচ থেকে একশ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ১০ থেকে ২০ হাজারের মতো মানুষ মারা যায়। আর প্রতিবছর বিশে^র যেসব দেশের মানুষের ডেঙ্গু সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়, তার প্রায় ৭৫ শতাংশই দেখা যায় এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।
ডেঙ্গু ঠেকাতে বছর জুড়ে মাস্টারপ্ল্যান প্রয়োজন বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান। তিনি বলেন, আতঙ্কিত না হয়ে সবাই মিলে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে ডেঙ্গু রোগ পালিয়ে যাবে। গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষ যেন পরীক্ষানির্ভর সঠিক চিত্রটি জানতে পারে। তাহলে আতঙ্ক বা হতাশা অনেক কমে যাবে বলে মনে করেন অধ্যাপক কামরুল। বাংলাদেশের প্রতিটি বাড়িতে নিজস্ব মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে, খুব কম বাড়ি আছে যারা সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার মশক নিধন কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করে। এ ছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে পরিবারের সদস্যরা নিজেরাই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যথেষ্ট সক্ষম।
তিনি আরও বলেন, সরকার বা সিটি করপোরেশনের নেতৃত্বে সামাজিক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে বছর জুড়ে ব্যাপক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাতে হবে।