ঢাকা শুক্রবার, ৯ই মে ২০২৫, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩২


নকশা নিয়ে চলছে ‘নকশা’

চার বছরে চূড়ান্ত হয়নি পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ নকশা


১ ডিসেম্বর ২০১৯ ২১:২১

আপডেট:
১ ডিসেম্বর ২০১৯ ২১:৩২

প্রায় চার বছর আগে প্রকল্প শুরু হলেও আজও চূড়ান্ত হয়নি পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পের নকশা। ফলে বাস্তবায়নে নানা জটিলতায় রয়েছে সরকারের অগ্রাধিকারভুক্ত প্রকল্পটি। বাস্তবায়নেও ধীরগতি কাটছে না।

এরই মধ্যে প্রকল্পের ব্যয় সংশোধন করা হয়েছে একবার। এখন প্রকল্প এলাকার ইউটিলিটি স্থানান্তরসহ বাস্তবায়নের বিভিন্ন অংশে বাড়তি ব্যয় করতে হবে, চলছে সে প্রক্রিয়া। বিদেশি পরামর্শকদেরও ভিসার মেয়াদ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। রয়েছে চীনের অর্থছাড় নিয়ে অনিশ্চয়তা। বাড়তি ব্যয়ের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে রেল বিভাগ সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন করে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানোর আগে আরও যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন। কারণ কোনো প্রকল্পই দুবারের বেশি সংশোধন না করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে।

এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন গতকাল শনিবার মোবাইল ফোনে বলেন, কোনো প্রকল্প অনুমোদনকালে ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয় ঠিকই, কিন্তু বাস্তবায়ন পর্যায়ে গিয়ে

অনেক সমস্যা হয়। যেমনটি হয়েছিল পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের মতো পদ্মা রেল লিংক প্রকল্পেও তেমন সমস্যাই হচ্ছে। নকশাসহ বিভিন্ন বিষয় সংশোধন করতে হচ্ছে। এর মধ্যে আরও প্রায় ৩০০ একর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এটি করতে নতুন করে প্রকল্পের ব্যয় বাড়তে পারে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু হয়ে গেলেও এই রেলসংযোগ প্রকল্পের জন্য আরও কয়েকটি সেতু করা লাগবে। তুরাগ ও ধলেশ^রী নদীর ওপর ব্রিজ করতে হবে। সব মিলিয়ে ২০২৪ সালের মধ্যে ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হবে। দক্ষিণাঞ্চল পুরোটাই রেলের আওতায় আসবে। তিনি আরও বলেন, চীন এই প্রকল্পে বড় অঙ্কের অর্থায়ন করছে, তাদের হাজার হাজার লোক এখানে কাজ করছে। চীনা পরামর্শকদের ভিসাসংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চীনের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থছাড় করাতে কাজ চলছে।

সম্প্রতি এই প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির দ্বিতীয় সভা হয়েছে সেতু ভবনে। সভায় প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা সমস্যার কথা উঠে আসে। সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় মোট ৪টি সেকশনে কাজ চলছে। এগুলোর বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ১৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ঋণদানকারী চীনের এক্সিম ব্যাংকের অর্থছাড়সংক্রান্ত জটিলতাও সমাধান হয়নি। ফলে বাস্তবায়নে গতি আসছে না।

কার্যপত্রে বলা হয়েছে, প্রকল্পের কমেন্সমেন্ট তারিখ থেকে প্রায় ১ বছর পর মূল কাজের নকশা দাখিল করে চায়না প্রতিষ্ঠান সিআরইসি। তবে ডিটেইল ডিজাইনের সঙ্গে ঠিকাদার সম্পাদিত জিআই তথ্যে ভিন্নতা রয়েছে। এখন এ কাজের সমন্বয় ও দেরিতে নকশা দাখিলের কারণে ব্যয় বাড়াতে হবে। কিছু কারিগরি বিষয়ও প্রকল্পের অগ্রগতিকে ব্যাহত করছে। এর মধ্যে পদ্মা সেতুর দুই পাশে নির্মিত ভায়াডাক্ট ২ ও ৩-এর পাইলট পাইলের টেস্ট রেজাল্ট সন্তোষজনক না হওয়ায় এক্সপার্টদের সঙ্গে নতুন করে আলোচনা করতে হচ্ছে, যা এখনো চলমান রয়েছে। এ সমস্যা সমাধান করতে হলে বিদ্যমান পাইলের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করার প্রয়োজন হবে।

নির্মাণ চুক্তি অনুসারে, প্রকল্প এলাকায় ঠিকাদারকে সব ধরনের স্থাপনা ও ইউটিলিটি সরিয়ে খালি সাইট স্থানান্তর করতে হবে। কিন্তু গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎলাইনসহ বিভিন্ন স্থাপনা সরাতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুসারে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। এ জন্য এ খাতে ব্যয় বাড়াতে হবে। এতে আরও বলা হয়, প্রকল্পের আওতায় জমি অধিগ্রহণে জেলা প্রশাসকরা দেরি করেছেন।

নতুন করে আরও ৩০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা লাগবে। অন্যদিকে ইউটিলিটি শিফটিং কাজের ব্যয় মোট প্রকল্পের ব্যয় ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখার বিষয়ে একটি নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রণালয়। ব্যয় সীমিত রাখার বিষয়টি পরিকল্পনা কমিশনকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ইউটিলিটি ও জমি অধিগ্রহণে সময় যত বেশি লাগবে, প্রকল্প বাস্তবায়নে মেয়াদ ও ব্যয় তত বাড়বে।

কার্যপত্রে বলা হয়েছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পদ্মা সেতুর সাইট বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে। পদ্মা সেতুতে সব ডেক সøাব বসানো হয়ে গেলে, রেললাইন বসানোর কাজটি অত্যন্ত কঠিন হয়ে যাবে।

এ জন্য পদ্মা সেতু প্রকল্প কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেওয়া হবে বলে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির ওই সভায় জানান প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী গোলাম ফখরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, প্রকল্পটি ফাস্টট্র্র্যাকভুক্ত হলেও কাজ বাস্তবায়ন ফাস্টট্র্যাকভিত্তিতে হচ্ছে না। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে জটিলতা সমাধানে যত দেরি হবে, ব্যয়ও সেভাবে বাড়তে থাকবে। এতে রাষ্ট্রীয় যে ক্ষতি হবে, সে বিষয়টি সভায় অবহিত করা হয়েছে।

কার্যপত্রে আরও বলা হয়েছে, এই প্রকল্পের জন্য পরামর্শকরা (৫৯৭০ জনমাস) কাজ করছেন। এর মধ্যে ১১২০ জনমাস সেবা নেওয়া হয়েছে। বাকি পরামর্শকের মধ্যে অনেকের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, যা দ্রুত সমাধান না হলে কাজের ব্যাঘাত ঘটবে।

এ ছাড়া আরও কিছু বিষয় রয়েছে, যার জন্য এই প্রকল্পে বাস্তবায়ন ব্যয় আরও বাড়াতে হবে। এ বিষয়ে ওই সভায় পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সিনিয়র সহকারী প্রধান আবুল বাকের মো. তৌহিদ বলেন, প্রকল্পটির ব্যয় এর আগে একবার বাড়ানো হয়েছে, এখন নতুন সংশোধনের আগে ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের উপপ্রধান মাসুমা আকতার বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থছাড়সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে চীনের এক্সিম ব্যাংককে চিঠি দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এর কপি এখন চীনা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।

২০২৪ সালনাগাদ বরিশালসহ পুরো দক্ষিণাঞ্চলকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় আনার লক্ষ্যে পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেলপথ নির্মিত হবে। এই প্রকল্পে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ৩৯ হাজার ২৫৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৭৩ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হচ্ছে। ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদনের সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বর। ২০১৮ সালের এপ্রিলে প্রকল্পের ব্যয় আরও ৪ হাজার ২৬৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাস্তবায়নকাল ধরা হয়।