সোহরাওয়ার্দীর পরিচালককে দুদকে তলব

রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়াকে তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অনিয়ম ও শতকোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানে তাকে তলব করা হয়েছে। গতকাল রবিবার দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে পাঠানো তলবি নোটিসে ৫ ডিসেম্বর তাকে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দিতে বলা হয়েছে। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
দুদকের উপপরিচালক শাসছুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে উত্তম কুমারকে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ও ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত মেডিকেল কলেজের যন্ত্রপাতি ক্রয়ের তালিকা ও ব্যয়িত অর্থের হিসাবের নথিপত্র সঙ্গে নিয়ে আসার জন্য বলা হয়েছে। ১৪ ফেব্রম্নয়ারির হাসপাতালে যে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল তাতে পরিচালকের কারসাজির অভিযোগও পাওয়া গেছে।
দুদকে পাওয়া অভিযোগ অনুযায়ী, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি ওটি লাইটের সরকার নির্ধারিত মূল্য প্রায় ৬ লাখ টাকা হলেও তা কেনা হয়েছে ৯৬ লাখ টাকায়। অর্থাৎ ১৬ গুণ দামে কেনা হয়েছে এটি। এভাবে বিভিন্ন চিকিৎসাসামগ্রী কেনায় হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বিপুল অর্থ। এসব অনিয়মের প্রায় সবই করা হয়েছে হাসপাতালের পরিচালক উত্তম কুমার বড়ুয়ার নেতৃত্বে। এজন্য তিনি গড়ে তুলেছেন একটি সিন্ডিকেট ও সন্ত্রাসী বাহিনী। চিকিৎসক হিসেবে দুটি ‘ডক্টরস কোড’ ব্যবহারের প্রমাণও আছে তার বিরুদ্ধে।
দুদকে পাওয়া অভিযোগ অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ৬ সেপ্টেম্বর অপারেশন থিয়েটারের জন্য একটি ওটি লাইট কেনা হয় ৭৯ লাখ ৮৫ হাজার টাকা দরে। অথচ সরকারি ‘প্রাইস গাইডলাইনে’ একটি ওটি লাইটের সর্বোচ্চ দাম উল্লেখ করা ১০ লাখ ৬৬ হাজার ৪০০ টাকা। অর্থাৎ দুটি ওটি লাইট কিনে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। একই বছর যন্ত্রপাতিসহ একটি কোবলেশন মেশিন কেনা হয়েছে ৯৬ লাখ টাকায়, আরেকটি ২৫ লাখ ৬৪ হাজার টাকায়। কিন্তু সরকারি প্রাইস গাইডের (সিঅ্যান্ডএফ-এফওবিসহ) দাম ধরা আছে ৬ লাখ ৩৯ হাজার ৩০০ টাকা। অর্থাৎ এ দুটি মেশিন কিনে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা। ভেন্টিলেটরসহ অ্যানেসথেসিয়া মেশিন কেনা হয়েছে ৫৮ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকায়। গাইডলাইনে যার সর্বোচ্চ ক্রয়সীমা ৭ লাখ ৭৮ হাজার ৬০০ টাকা।
দুদকে পাওয়া অভিযোগ অনুযায়ী, ২০১২ সালে চক্রটির উত্থানের পর ওই বছরই কিডনি চিকিৎসায় ব্যবহৃত লিথোপ্রিপসি মেশিন প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকায় কেনা হয়, যা এক বছর না যেতেই পরিত্যক্ত হয়। একই বছর অনিয়মের মাধ্যমে দ্বিগুণেরও বেশি দামে সাড়ে ৭ কোটি টাকায় একটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়, যা ছয় মাস না যেতেই বিকল হয়ে পড়ে।
পরবর্তী সময়ে আবার ৭০ লাখ টাকায় ঠিক করা হলেও এখন পরিত্যক্ত। ফলে প্রতি মাসে অক্সিজেন সিলিন্ডারের পেছনে বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। লাশ রাখার অবকাঠামো নির্মাণ না করেই কেনা হয়েছে ডিপ ফ্রিজ। লেসিক মেশিনের বাজারমূল্য আড়াই কোটি টাকা হলেও কেনা হয় সাড়ে ৪ কোটি টাকায়।
প্রায় ২ কোটি টাকা মূল্যের এন্ডোসকপি মেশিন অব্যবহৃত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। প্রায় ৩ কোটি টাকা মূল্যের ইএনটি লেজার মেশিন পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। সবই ওই সিন্ডিকেটের কাণ্ড। এছাড়া হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের জন্য অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনেছেন তিনি। চলতি বছর ২৯ জুলাই চট্টগ্রাম সদর রেজিস্ট্রি অফিসে ২ কোটি টাকা মূল্যে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ মন্দিরসংলগ্ন একটি ভবন জমিসহ রেজিস্ট্রি করেছেন।
যদিও প্রকৃতপক্ষে জমির মূল্য বাবদ তিনি পরিশোধ করেছেন সাড়ে ৩ কোটি টাকা। এর আগে ৭ জানুয়ারি তার ভাই দিলীপ কুমার বড়ুয়ার নামে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ মন্দিরসংলগ্ন একটি জমিসহ বাড়ি ক্রয়ের বায়না ৫ কোটি টাকা মূল্য দেখানো হয়েছে। যদিও প্রকৃতপক্ষে পরিশোধ করা হয়েছে ১২ কোটি টাকা।
এছাড়া ঢাকার ইন্দিরা রোডে দুই হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট, ধানমণ্ডি ২৮-এ তিন হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট, শ্যামলী স্কয়ারে দোকানসহ নামে-বেনামে বিপুল অর্থসম্পদ রয়েছে উত্তম কুমার বড়ুয়ার। দেশের বাইরে মালয়েশিয়ায়ও তিনি ফ্ল্যাট কিনেছেন এবং সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ফ্ল্যাট কেনার জন্য অগ্রিম টাকা দিয়েছেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, চলতি বছর ১৪ ফেব্রম্নয়ারি সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের যে খবর গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়, তাও সাজানো ছিল বলে প্রমাণ পেয়েছেন প্রকৌশলীরা। প্রকৌশলীরা নিখুঁতভাবে পরীক্ষা করে দেখেছেন, এ আগুনের শুরু বিদ্যুৎ লাইন বা সিস্টেমের কোনো ত্রুটির কারণে নয়। এর পেছনেও পরিচালকের কারসাজির অভিযোগ করেছেন অনেকে। এসব অভিযোগের বিষয়ে মোবাইল ফোনে উত্তম কুমার বড়ুয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমি এখনো দুদকের নোটিস পাইনি। যেসব অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে তার সবই মিথ্যা। আমার কাছে সব ডকুমেন্ট আছে। সময়মতো সেগুলো দুদকে পৌঁছে দেব।’