ঢাকা রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৬ই বৈশাখ ১৪৩১


দ্রুত সম্পদ বাড়ছে ধনীর হারাচ্ছে গরিব


৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:২১

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:২৮

দেশজুড়ে সুষম উন্নয়ন ও আয়বৈষম্য কমানোর সরকারের নানা প্রতিশ্রুতি ও উদ্যোগের সুফল মিলছে না; বরং দেশের গরিব মানুষ দিন দিন আরও গরিব হচ্ছে, দ্রুত সম্পদ বাড়ছে ধনীদের। দেশের সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ মানুষের সম্পদের পরিমাণ ছয় বছরের ব্যবধানে দুই-তৃতীয়াংশ কমেছে। এই সময়ে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের সম্পদ বেড়েছে ২ শতাংশেরও বেশি। ধনী-গরিবের বৈষম্য বাড়ার এ চিত্রকে ‘প্রমাণিত’ হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভের (এইচআইইএস) চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে দরিদ্র ও সবচেয়ে ধনীদের সম্পদের ব্যবধান চূড়ান্ত পর্যায়ে গেছে।

ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য মাপার সূচক গিনি সহগ দশমিক ৫০-এ পৌঁছালে দেশগুলো ‘বৈষম্যের মহাবিপদ’ পর্যায়ে রয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয় বলে জানান অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশে গিনি সহগ উঠেছে দশমিক ৪৮২-এ। ২০১০ সালে এটি ছিল দশমিক ৪৫৮-এ। শহরাঞ্চলে এই সূচক পৌঁছে গেছে দশমিক ৪৯৮-এ। ছয় বছর আগে এটি ছিল দশমিক ৪৫২-এ। বাংলাদেশে ধনী-দরিদ্রের এই বৈষম্যকে বিপদজ্জনক বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, কর্মসংস্থান কমে যাওয়া ও সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীতে অনিয়মের কারণে গরিব মানুষের আয় কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাড়ছে ধনীদের সম্পদ। তবে সরকারের পরিকল্পনাবিদরা মনে করছেন, কোনো দেশ যখন দ্রুত উন্নয়ন করে, তখন স্বাভাবিকভাবেই বৈষম্য বাড়ে। সরকার বৈষম্য কমাতে দরিদ্রদের জন্য নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। তাই বৈষম্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।

বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে গরিব এমন ৫ শতাংশ মানুষের ২০১০ সালে সম্পদ ছিল দেশের মোট সম্পদের দশমিক ৭৮ শতাংশ, ২০১৬ সালে তা কমে নেমে এসেছে দশমিক ২৩ শতাংশে। এ সময়ে গ্রামের গরিব মানুষের সম্পদ আরও বেশি কমেছে। ২০১০ সালে গ্রামের ৫ শতাংশ গরিব মানুষের সম্পদ ছিল দেশের মোট সম্পদের দশমিক ৮৮ শতাংশ। ২০১৬ সালে তাদের সম্পদের পরিমাণ কমে হয়েছে দশমিক ২৫ শতাংশ। ২০১০ সালে শহরাঞ্চলের সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশের সম্পদের হার ছিল দশমিক ৭৬ শতাংশ, ২০১৬ সালেই তা কমে নেমেছে দশমিক ২৭ শতাংশে। অন্যদিকে, ২০১০ সালে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশের সম্পদের

পরিমাণ ছিল দেশের মোট সম্পদের ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। ২০১৬ সালে তাদের সম্পদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৮২ শতাংশে। এই ছয় বছরের ব্যবধানে শহুরে ধনীদের সম্পদ বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। ২০১০ সালে শহরের ৫ শতাংশ ধনীর সম্পদ ছিল দেশের মোট সম্পদের ২৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ, ছয় বছরের ব্যবধানে তাদের সম্পদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ দশমিক ০৯ শতাংশে। এই সময়ে গ্রামের সর্বোচ্চ ধনীদের সম্পদও আগের তুলনায় বেড়েছে।

সিনিয়র সচিব ও পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. শামসুল আলম গতকাল বলেন, সমাজের সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ মূলত কৃষিকাজ করে। তাই তাদের সম্পদ বাড়ে না। আর ধনীরা বেশি পরিমাণ অর্থনৈতিক কর্মকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ত, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতে তাদের অবদান অনেক বেশি। তাই এটা স্বাভাবিক যে ধনীদের সম্পদ যে হারে বাড়বে, গরিবের সম্পদ সে হারে বাড়বে না।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন দ্রুত উন্নতি করছে। কোনো দেশ যখন উন্নয়নের এই পর্যায়ে থাকে, তখন স্বাভাবিকভাবেই আয়বৈষম্য বাড়ে। বৈষম্য কমাতে সরকারের তরফ থেকে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় বাজেটে ৭৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রেখে দরিদ্রদের মাঝে দেওয়া হচ্ছে। সরকার স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সেবা খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে। প্রগতিশীল করনীতির আওতায় ধনীদের কাছ থেকে অধিক হারে আয়কর আদায় করা হচ্ছে। সরকারের এসব নীতির কারণে একসময় বৈষম্য সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে বলে জানান তিনি।

আয়বৈষম্য বাড়ার সঙ্গে দুর্নীতির সম্পর্ক কেমনÑ এমন প্রশ্নে ড. শামসুল আলম বলেন, সুযোগ পেলে দুর্নীতি সবাই করে। এ ক্ষেত্রে ধনী-গরিব নেই। তবে ধনীদের দুর্নীতির সুযোগ বেশি। তবে বৈষম্য বাড়লে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। সরকার সে ব্যাপারে সজাগ রয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা এবি আজিজুল ইসলাম বুধবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, দেশে যে হারে কর্মসংস্থান বাড়ার কথা ছিল, তা বাড়েনি। গত দশ বছরে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বরং কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে। এর মধ্যে কৃষি খাতে কর্মসংস্থান কমেছে ব্যাপক হারে। কর্মসংস্থান না বাড়লে গরিব মানুষের আয় কমবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু ধনীদের ক্ষেত্রে চিত্র পুরো উল্টো। ফলে আয়বৈষম্য বেড়েই চলছে। এ ছাড়া মোট দেশজ উৎপাদনের জিডিপি যে হিসাব দেওয়া হচ্ছে বাস্তবতার সঙ্গে তার মিল কম। এর মানে প্রবৃদ্ধি বাস্তবসম্মত নয়, প্রশ্ন রয়েছে।

তিনি বলেন, গরিব মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় যা দেওয়া হচ্ছে, সেখানে ব্যাপক অনিয়ম রয়েছে। যাদের পাওয়ার কথা তারা পায় না, দুর্নীতির ফলে এসব সুবিধা অন্যরা পায়। এটাও বৈষম্য বৃদ্ধি পাওয়ার একটা বড় কারণ।

বিবিএসের তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপসচিব ও এইচআইইএস প্রকল্পের সাবেক পিডি ড. দীপংকর রায় দেশ রূপান্তরকে বলেন, ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে আয়বৈষম্য বেড়েছে। উন্নয়নশীল দেশে এমনটা হতে পারে। বৈষম্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে তিনি জানান, এটা হতে পারে বিনিয়োগসংক্রান্ত কারণে। ধনীরা বিনিয়োগে যে টাকা আয় করছে, গরিব সেই পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করতে পারছে না। ফলে আয়বৈষম্য তৈরি হচ্ছে।

গত সেপ্টেম্বর মাসে এক অনুষ্ঠানে ‘বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য : সমাধান কোন পথে?’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, ১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশের গিনি সহগ ছিল শূন্য দশমিক ৩৬, যা ২০১৬ সালে এসে দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৪৮৩-এ। বাংলাদেশ বৈষম্যের মহাবিপদজ্জনক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। ধনীরা আরও ধনী হচ্ছে। ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল সময়ে বাংলাদেশের ধনীদের সম্পদ ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে বেড়েছে।

৮ দশমিক ১৩ শতাংশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে বাহাদুরি করার কিছু নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই প্রবৃদ্ধির হার সত্ত্বেও দেশে বৈষম্য বাড়ছে। বাংলাদেশ এখন একটি ‘উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে’ পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে।