ঢাকা মঙ্গলবার, ২১শে মে ২০২৪, ৮ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১


মেয়ের কবরের পাশে বসে কাঁদছেন বাবা, মূর্ছা যাচ্ছেন মা

ফোন পেয়ে সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হন রুম্পা


৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৩:০৬

আপডেট:
২১ মে ২০২৪ ১১:২৯

স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী ও পুলিশ পরিদর্শক রোকন উদ্দিনের একমাত্র মেয়ে রুবাইয়াত শারমিন রুম্পা (২০)। বুধবার রাতে রাজধানীর রমনা থানাধীন সিদ্ধেশ্বরী থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সেদিন সন্ধ্যায় বাসা থেকে বের হয়ে যান তিনি। সঙ্গে নিয়ে যাননি মোবাইল ফোনও।

ওই রহস্যজনক মৃত্যুর তদন্তে শুক্রবার রাত ৮টা পর্যন্ত কোনো ক্লু বের করতে পারেনি পুলিশ।

পুলিশ জানায়, তার মোবাইল ফোনের কললিস্টের সূত্র ধরে রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি কারা তাকে কেন ডেকে নিয়ে গেছে সেটা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে।

রমনা থানার ওসি মনিরুল ইসলাম আমাদের দিন কে বলেন, বুধবার সন্ধ্যার পর রুম্পা বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন। তিনি নিজের মোবাইল ফোনটিও সঙ্গে নেননি। তার মৃত্যুর বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়। আমরা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছি। থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। সেটার তদন্ত চলছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা আমাদের দিন কে বলেন, শান্তিবাগে রুম্পার বাসার গলি ও যেখানে রুম্পার লাশ পাওয়া গেছে সেখানকার কয়েকটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। সেগুলো বিশ্লেষণ চলছে। আশা করছি শিগগিরই মৃত্যু নিয়ে রহস্য উদঘাটন করা যাবে এবং ঘাতকরা গ্রেপ্তার হবে।

তা ছাড়া রুম্পার মোবাইলের কললিস্ট চেক করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে জানা যাবে কে তাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়েছে। কারণ বাসা থেকে রুম্পাকে ফোনে ডেকে নেওয়া হয়। তা ছাড়া এ ক্ষেত্রে প্রেমঘটিত বিষয়কেও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

জানা গেছে, ঘটনার দিন রুম্পা দুটি টিউশনি শেষে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরেন। পরে কাজ আছে বলে বাসা থেকে বের হন তিনি। বাসা থেকে নিচে নেমে নিজের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ও জুতা বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে এক জোড়া পুরোনো স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে চলে যান। রাতে আর বাসায় ফেরেননি তিনি।

এদিকে,মেয়ের কবরের পাশে বসে কাঁদছেন পুলিশ কর্মকর্তা বাবা। গৃহিণী মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নিহত শিক্ষার্থী রুবাইয়াত শারমিন রুম্পার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বিজয়নগরে চলছে মাতম। রুম্পার মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড দাবি করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন স্বজনেরা।

মেয়ের শোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা নাহিদা আক্তার পারুল। বারবার চিৎকার করে বলছেন, ‘আমার মেয়েকে এনে দাও, আমার মেয়েকে এনে দাও। আমার মেয়েকে কেন মেরে ফেলল, আমি বিচার চাই, বিচার চাই।’ স্বজনেরা তাকে সান্ত্বনা দিয়েও কান্না থামাতে পারছেন না।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাহিদা আক্তার পারুল বলেন, ‘মেয়ে জরুরি কাজের কথা বলে বাইরে গেল, ফিরল লাশ হয়ে। না জানি আমার মেয়েকে কত কষ্ট দিয়ে ওরা মেরেছে। মরার সময় মেয়েটা কতবার না জানি, মা-মা বলে চিৎকার করেছে।’

রুম্পার চাচা নজরুল ইসলাম  আমাদের দিন কে কে বলেন, ‘রুম্পাকে হত্যার পর কোনো একটি ভবনের ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয়, এটা নিশ্চিত। তদন্ত চলছে, দেখা যাক কী হয়’।

তিনি আরো বলেন, আমার ভাতিজির সঙ্গে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির একটি ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। তাদের ভেতরে ঝামেলা চলছিল বলে আমরা শুনেছি। তবে এ হত্যার সঙ্গে ওই ছেলের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা আমরা জানি না। এ ব্যাপারে আমি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। কর্তৃপক্ষ ওই ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে।

নিহত রুম্পার চাচা নজরুল ইসলাম বলেন, রুম্পা পাশের একটি বাড়িতে টিউশনি করতে গিয়েছিল। সেখান থেকে সন্ধ্যার দিকে নিজ বাসায় নিচে যায় রুম্পা। এরপর রুম্পা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া তার এক চাচাতো ভাইকে ফোন করে বাসার নিচে স্যান্ডেল আনতে বলে। সে স্যান্ডেল নিয়ে এলে পায়ের হিল খুলে স্যান্ডেল পরে রুম্পা। ওই চাচাতো ভাইয়ের কাছে রুম্পা কানের দুল, মোবাইল, ঘড়ি , হিল জুতা ও টাকাসহ ব্যাগ দিয়ে দেয়। সেগুলো ওপরে নিয়ে যেতে বলে। একই সঙ্গে মাকে বলতে বলে, তার আসতে দেরি হবে।

নজরুল বলেন, ‘আমার প্রশ্ন কেন সে এগুলো রেখে যাবে? আত্মহত্যার পরিকল্পনা? তাহলে তো নিজের বাড়িতেই ছাদ আছে। ওখানে যাবে কেন? নাকি কোনো ঝামেলা ছিল, তাই এগুলো রেখে গিয়েছিল ? এসব ভালো করে তদন্ত করতে হবে।’

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় সেমিস্টারের একজন শিক্ষার্থী আমাদের দিন কে জানান, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী রিফাতের সঙ্গে রুম্পার প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। কয়েক দিন ধরে তাদের বন্ধুত্বে মধ্যে টানাপোড়েন চলছিল।’

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শেখ নাহিদ নেওয়াজ আমাদের দিন কে বলেন, ৬৯ ব্যাচের ওরিয়েন্টশন ক্লাস নিয়েছিলাম। রুম্পা একজন শান্ত ও লক্ষ্মী মেয়ে ছিল। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্ট্রে বার্ড’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না। ঘটনাটি তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।

রমনা থানা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সিদ্ধেশ্বরীর ৬৪/৪, নম্বর বাড়ির পাশে আরো দুটি ভবন রয়েছে। আমরা ধারণা করছি, যেকোনো একটি ভবন থেকে তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত আমরা কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারিনি। ঘটনাস্থলের পাশে দুটি ভবন আছে। দশ তলা ভবনটির নিরাপত্তাকর্মী সুমন পুলিশকে জানিয়েছেন, বুধবার রাত ১১টার দিকে ওই ভবনের সামনে এক নারীকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। বিষয়টি তিনি অন্যদের জানান।

রুম্পা মালিবাগের শান্তিবাগে মা ও ভাইয়ের সঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকতেন। তার বাবা রোকনউদ্দিন হবিগঞ্জে পুলিশের পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন। বৃহস্পতিবার রাত ২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে রুম্পার লাশ গ্রহণ করেন তার ভাই আশরাফুল ইসলাম।

তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এদিকে রুম্পা হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শুক্রবার সকালে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিক্ষোভ মিছিলসহ ভিকারুন নিসা নূন স্কুলের সামনে যায় শিক্ষার্থীরা।